আগরতলা আমলার কারণ কি ছিল?

আগরতলা আমলার কারণ কি ছিল? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাষ্ট্র…

আগরতলা আমলার কারণ কি ছিল?

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ নামে পরিচিত) দায়েরের প্রধান কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কথিত ষড়যন্ত্র। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই মামলাটি দায়ের করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দমন করতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

মামলাটির কারণ ও উদ্দেশ্য দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়—পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ এবং বাঙালিদের প্রকৃত উদ্দেশ্য:

১. পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ (মামলার কারণ)

পাকিস্তান সরকার, বিশেষ করে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার, ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই মামলা দায়ের করে। তাদের অভিযোগের মূল বিষয়বস্তু ছিল:

  • রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিচ্ছিন্নতা: অভিযোগ করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (যাকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছিল) এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্যসহ মোট ৩৫ জন ব্যক্তি ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
  • ভারতীয় যোগসূত্র: মামলার অভিযোগে বলা হয়, এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে করা হয়েছিল। এই ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিদেশী-নির্ভর চক্রান্ত হিসেবে প্রচার করতে।
  • রাজনৈতিক দমন: পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে গড়ে ওঠা স্বায়ত্তশাসনের তীব্র আন্দোলনকে যেকোনো মূল্যে দমন করতে চেয়েছিল। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব প্রধান বাধা ছিলেন, তাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াই ছিল এই মামলার মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

২. বাঙালিদের প্রকৃত উদ্দেশ্য (ঐতিহাসিক পটভূমি)

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই মামলাটি ছিল বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বাস্তব চেষ্টা, যা তৎকালীন সরকার ‘ষড়যন্ত্র’ বলে প্রচার করে:

  • শোষণ ও বঞ্চনা: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত উপেক্ষিত ও অবহেলিত হচ্ছিল। এই বৈষম্যের কারণে বাঙালির মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছিল।
  • স্বায়ত্তশাসনের দাবি: ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন, তখন তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। এই ছয় দফা ছিল মূলত একটি স্বাধীনতার সনদ
  • সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা: সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান তীব্র বৈষম্যের কারণে কিছু বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা উপলব্ধি করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মতিতে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেন।
  • লক্ষ্য: অভিযুক্ত শওকত আলী (মামলার অন্যতম আসামি) তার বইয়ে স্বীকার করেছেন যে, তাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে পূর্ব পাকিস্তানের সবক’টি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, তাদের বন্দী করা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা

৩. মামলার তাৎপর্য

যদিও পাকিস্তান সরকার এটিকে ষড়যন্ত্র মামলা বলে প্রচার করেছিল, কিন্তু বাঙালির কাছে এটি ছিল স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট ধাপ। এই মামলা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বীর’‘জাতির নায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তীব্র গণ-আন্দোলনের জন্ম দেয়, যা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১ম বর্ষ ডিগ্রি সাজেশন ২০২৫

Download pdf

Join our Facebook Group

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *