সংক্ষেপে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা কর

ভূমিকা সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান। এটি মানুষের…

ভূমিকা

সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান। এটি মানুষের জীবন, সমাজ, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে। আজকের বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, বন উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের সংকট—এসব বিষয় কেবল বিজ্ঞান নয়, সামাজিক গবেষণারও কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। তাই পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা সহজ ভাষায় আলোচনা করবো পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান আসলে কী, এর বৈশিষ্ট্য, গবেষণার ক্ষেত্র ও সমাজ জীবনে এর গুরুত্ব।


পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান কী

পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্ককে সমাজবিজ্ঞানীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ধরণ, পরিবেশগত নীতি, প্রযুক্তির প্রভাব, জনগণের আচরণ, অর্থনৈতিক কাঠামো—সব মিলিয়ে পরিবেশ ও সমাজ কিভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে তা বিশ্লেষণ করে।

এটি কেবল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ নয়; বরং মানুষ কিভাবে পরিবেশের সাথে খাপ খায়, কিভাবে তা নষ্ট করে, আবার কীভাবে তা রক্ষা করতে পারে—এসব সামাজিক বিশ্লেষণকেও গুরুত্ব দেয়। তাই পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি বোঝা মানে হলো মানুষের জীবনধারা ও পরিবেশের সম্পর্ককে একসাথে দেখা।


পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি

পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি বোঝার জন্য কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ।

১. আন্তঃবিষয়ক প্রকৃতি

এটি কেবল সমাজবিজ্ঞান নয়; ভূগোল, পরিবেশবিদ্যা, অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান—সবগুলো শাখার সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে এটি আন্তঃবিষয়ক একটি বিদ্যা।

২. সামাজিক দৃষ্টিকোণ

পরিবেশের সমস্যাকে কেবল বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না, বরং সামাজিক সমস্যা হিসেবে ধরা হয়। যেমন, দূষণের প্রভাব ধনী-গরিব বা শহর-গ্রাম মানুষের উপর ভিন্নভাবে পড়ে।

৩. পরিবর্তনশীলতা

সমাজ যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি পরিবেশের ব্যবহারও পরিবর্তিত হয়। তাই পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান সবসময় পরিবর্তনশীল সমাজ বাস্তবতা ও নীতির সঙ্গে যুক্ত।

৪. নীতি ও কর্মমুখী ধারা

পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়। পরিবেশ রক্ষা, টেকসই উন্নয়ন, ন্যায্য সম্পদ বণ্টন—এসব ক্ষেত্রেও এটি নীতি প্রণয়নে অবদান রাখে।

এগুলো মিলিয়ে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি গবেষণায় সামাজিক দিককে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।


পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের পরিধি

এখন প্রশ্ন হলো, পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্র বা পরিধি কোথায়? এটি বহুমুখী।

১. পরিবেশ ও সমাজের সম্পর্ক

মানুষ কিভাবে পরিবেশ ব্যবহার করে, সমাজের ভেতরে কাদের কাছে বেশি বা কম সম্পদ থাকে—এসব বিশ্লেষণ এর অংশ।

২. শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাব

শিল্পায়ন দূষণ সৃষ্টি করে, নগরায়ন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। এই প্রভাব সমাজের ভেতরে কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ক্ষেত্র।

৩. পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা

বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ—এসবের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা সমাজ কাঠামোর ওপরও প্রভাব ফেলে।

৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা খরা মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ফলে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসনে বাধ্য হয়।

৫. নীতি ও আইন

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs)—এসবের সমাজবিজ্ঞানীয় বিশ্লেষণও এর পরিধির মধ্যে পড়ে।

৬. সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ

মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনধারা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে বড় ভূমিকা রাখে। কোনো সমাজ প্রকৃতিকে পূজার অংশ হিসেবে দেখে, আবার কোনো সমাজ একে কেবল সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে।

এসব দিক স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি কেবল তাত্ত্বিক গবেষণায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং বাস্তব জীবনের নানা সমস্যাকে অন্তর্ভুক্ত করে।


পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব

সামাজিক সচেতনতা

পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান মানুষকে শেখায় যে পরিবেশ ধ্বংস মানে সমাজের ভিত্তি দুর্বল হওয়া।

ন্যায্য সম্পদ বণ্টন

এটি বোঝায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ ধনী-গরিব সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না।

নীতি প্রণয়ন

এটি সরকারের কাছে নীতিগত সুপারিশ দেয়, যেমন দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বন সংরক্ষণ, পানি ব্যবস্থাপনা।

বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান

গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজবিজ্ঞানীয় ব্যাখ্যা দেয়।


বাংলাদেশে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই শাখার গুরুত্ব আরও বেশি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, দূষণ—এসব সমস্যায় লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে নতুন নতুন পরিবেশ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি ভালোভাবে বোঝা এবং তা নীতি প্রণয়নে কাজে লাগানো অপরিহার্য।


চ্যালেঞ্জ

১. গবেষণার সীমাবদ্ধতা
২. নীতি বাস্তবায়নের অভাব
৩. সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি
৪. বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব


উপসংহার

সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি এটি শুধু সমাজবিজ্ঞানের শাখা নয়, বরং পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্ককে বোঝার জন্য অপরিহার্য এক বিদ্যা। এটি মানুষকে সচেতন করে, নীতি নির্ধারকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে। আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে পরিবেশ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব আরও বাড়বে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *