সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধর
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিভঙ্গি রবীন্দ্রনাথ…
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিভঙ্গি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী নিয়ে তাঁর গভীর ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রবন্ধটি রচিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে, যখন সমগ্র বিশ্ব এক চরম মানবিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ মানবসভ্যতার অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোকপাত করেন।
মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী: উদারতা, প্রেম ও সৃজনশীলতা
রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী হলো তার উদারতা, প্রেম, ক্ষমা, সৃজনশীলতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা। তিনি মনে করতেন, মানুষের এই গুণগুলোই তাকে পশুর স্তর থেকে আলাদা করেছে এবং সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যখন মানুষ এই মৌলিক মানবিক গুণগুলোকে বিসর্জন দেয়, তখনই সভ্যতা সংকটের মুখে পড়ে।
- ভালোবাসা ও মৈত্রী: প্রাবন্ধিক বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তার ভালোবাসার ক্ষমতা। পরস্পরের প্রতি প্রেম, সহানুভূতি এবং মৈত্রীই মানব সমাজকে টিকিয়ে রাখে। যখন স্বার্থপরতা, হিংসা এবং হানাহানি প্রকট হয়, তখন মানুষের ভেতরের এই মহৎ গুণগুলো চাপা পড়ে যায়।
- সৃজনশীলতা ও আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, মানুষের মধ্যে জ্ঞান অর্জন ও নতুন কিছু সৃষ্টির যে আকাঙ্ক্ষা, তা তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান—এসব কিছুর মধ্য দিয়ে মানুষ তার আত্মাকে প্রকাশ করে এবং এর মাধ্যমেই মানবজাতি উন্নত হয়।
- ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ: কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকা নয়, অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, লোভ, ক্ষমতার অন্ধ মোহ এবং সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে মানুষের এই ত্যাগের মানসিকতাকে গ্রাস করে।
সভ্যতার সংকট: পাশবিক শক্তির উত্থান
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, তৎকালীন পশ্চিমা সভ্যতা, যা বস্তুগত উন্নতিকে চরম বলে মনে করেছিল, তা কীভাবে শেষ পর্যন্ত পাশবিক শক্তির কাছে হার মেনেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও, যখন তা মানব কল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়, তখন তা আর সভ্যতা থাকে না, বরং বর্বরতায় রূপান্তরিত হয়। তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন সেই ক্ষমতা লিপ্সু মানসিকতার, যা জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ, বিদ্বেষ এবং সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে।
প্রাবন্ধিকের মতে, সভ্যতার প্রকৃত সংকট নিহিত রয়েছে মানবতার অবক্ষয়ে। যখন মানুষ তার ভেতরের পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এবং লোভ, হিংসা ও ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়, তখনই সভ্যতার ভিত নড়ে ওঠে। মানুষের আত্মিক উন্নতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই এই সংকটের মূল কারণ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আস্থা
এত হতাশার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণরূপে আশাহত হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ তার এই ভুল থেকে শিখবে এবং একদিন ঠিকই তার ভেতরের শ্রেষ্ঠ গুণগুলোকে জাগিয়ে তুলবে। তিনি “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” বলে উল্লেখ করেছেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আস্থা রেখেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, নতুন এক সূর্যোদয় হবে, যেখানে মানুষ আবার তার মানবিক মূল্যবোধকে পুনরুত্থিত করবে এবং এক সুস্থ ও সুন্দর সভ্যতার জন্ম দেবে।
সংক্ষেপে, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী হলো তার মানবিকতা, উদারতা, প্রেম ও সৃজনশীলতা। যখন এই গুণগুলো উপেক্ষিত হয় এবং পাশবিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই সভ্যতা সংকটের মুখে পড়ে। তবে, এই সংকটের মধ্যেও তিনি মানুষের অন্তর্নিহিত শুভবুদ্ধির ওপর বিশ্বাস রেখেছেন।