১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর ভূমিকা: বাংলাদেশের…

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর

ভূমিকা:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান। এটি ছিল সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের বিপুল আন্দোলনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যার মাধ্যমে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে এবং দেশে পুনরায় গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবেশকেই বদলে দেয়নি, বরং সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোতেও রেখেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করবো ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর কারণ ও ফলাফল, যাতে ঐ সময়ের বাস্তবতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়।


১. সামরিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

১৯৮২ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে দেশ চালানোর ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ তৈরি হয়। এই স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হতে থাকে, যার পরিণতি হয় ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান


২. রাজনৈতিক দলের ঐক্য

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), ও বাম রাজনৈতিক শক্তিগুলো একযোগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়। এই রাজনৈতিক ঐক্য জনগণকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল।


৩. ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা

ছাত্র সমাজ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর ক্ষেত্রেও তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। ছাত্র ঐক্যজোট ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করেছিল।


৪. নির্বাচন ব্যবস্থায় অনিয়ম

এরশাদ সরকারের সময়ে একাধিকবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলোতে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও বিরোধী দলের বর্জন লক্ষ্য করা যায়। এই নির্বাচনব্যবস্থা জনগণের আস্থা হারায় এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


৫. সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ

এরশাদ সামরিক বাহিনীর একজন ছিলেন বটে, কিন্তু তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশল সেনাবাহিনীর একটি অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই অসন্তোষ ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান কে একটি নতুন মাত্রা দেয়।


৬. মানবাধিকার লঙ্ঘন

এরশাদ শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও ছাত্রদের গ্রেফতার, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ছিল প্রায় নিয়মিত। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান কে ত্বরান্বিত করে।


৭. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতি

শাসনামলে এরশাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল ব্যাপক। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন না হওয়ায় ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান অবধারিত হয়ে ওঠে।


৮. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বৈধতা

এরশাদ সরকার ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধে ছিল এবং ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে। এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিরোধীদের আরো বেশি সক্রিয় করে তোলে, যা ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এ পরিণত হয়।


৯. আন্তর্জাতিক চাপ

তৎকালীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাচ্ছিল। এই বিদেশি চাপ ও সমর্থন ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর একটি পরোক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করে।


১০. মিডিয়ার জাগরণ

যদিও সরকারি নিয়ন্ত্রণে অনেক মিডিয়া ছিল, তবুও কিছু সাহসী পত্রিকা ও সাংবাদিক এই সময় সত্য ঘটনা তুলে ধরতে শুরু করে। মিডিয়ার ভূমিকা জনগণকে সচেতন করতে সাহায্য করে এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান কে সংগঠিত করতে সহায়তা করে।


১১. মেধাবী ছাত্রদের আত্মত্যাগ

নুর হোসেন, মিজান, জাফরসহ বহু মেধাবী ছাত্র ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। এই আত্মত্যাগ জনগণের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে এবং আন্দোলনকে আরও বেগবান করে।


১২. শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ

শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক দল নয়, কারখানা শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালকসহ নানান শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই সার্বিক অংশগ্রহণ ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান কে সত্যিকারের গণআন্দোলনে রূপ দেয়।


১৩. এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এটি ছিল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন। এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।


১৪. গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। এভাবে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও চলমান।


১৫. শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি

এই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও অধিকার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়, যা দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।


উপসংহার:

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধুমাত্র একটি সরকার পতনের ঘটনা ছিল না; এটি ছিল জনগণের সম্মিলিত চেতনার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে সবাই মিলে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করে, যেখানে জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। আজকের প্রেক্ষাপটে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এর গুরুত্ব পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, যাতে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গণতন্ত্রের সঠিক ইতিহাস ও মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে পারি।

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *