সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের বর্ণনা দাও। এবং বাংলার সুবেদার হিসেবে শায়েস্তা খানের অবদান নিরূপণ কর।

সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের বর্ণনা: একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ মুঘল সাম্রাজ্যের…

সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের বর্ণনা: একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ

মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) কেবল একজন সামরিক বিজেতা ছিলেন না, বরং একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবেও ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য তার সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চতায় পৌঁছেছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিশাল অংশ তাঁর শাসনের অধীনে এসেছিল। এই বিস্তৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়, যা দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং কৌশলগত বিচক্ষণতার ফল ছিল।

বাংলা, তার উর্বর ভূমি, সমৃদ্ধ সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থানের কারণে বরাবরই দিল্লির শাসকদের কাছে লোভনীয় ছিল। মুঘলদের আগমনের পূর্বে বাংলা আফগান শাসক এবং স্থানীয় জমিদারদের দ্বারা শাসিত হত, যারা প্রায়শই স্বাধীনভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করত। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় তাই মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য কেবল একটি প্রাদেশিক সংযোজন ছিল না, বরং পূর্বাঞ্চলে তাদের আধিপত্য বিস্তারের একটি অপরিহার্য ধাপ ছিল।

১. বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: মুঘল বিজয়ের প্রাক্কালে

মুঘলরা যখন ভারতে আসে, তখন বাংলা সুর বংশের শাসনের অধীনে ছিল। শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা বাংলার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এর ফলে বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষমতা স্থানীয় আফগান জমিদার ও ছোটখাটো শাসকদের হাতে চলে যায়। এই fragmented রাজনৈতিক পরিস্থিতিই সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর পথ সুগম করে। দাউদ খান কররানি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন আফগান শাসক, যার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং মুঘলদের প্রতি চ্যালেঞ্জিং মনোভাবই শেষ পর্যন্ত তাঁর পতন ডেকে আনে।

২. প্রথম পদক্ষেপ ও কৌশলগত প্রস্তুতি

সম্রাট আকবর বাংলার কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলার উর্বর ভূমি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, তিনি বাংলার দিকে ধীরে ধীরে তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন। প্রাথমিকভাবে, আকবর বাংলার অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং স্থানীয় শাসকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। এই কৌশলগত পদক্ষেপ সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।

৩. দাউদ খানের উত্থান ও মুঘল-আফগান সংঘাতের সূত্রপাত

দাউদ খান কররানি ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং দ্রুত নিজেকে একজন উচ্চাভিলাষী শাসক হিসেবে প্রমাণ করেন। তিনি আকবরের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মুঘলদের অধীনস্থ অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করেন। এই আক্রমণই মুঘলদের বাংলা বিজয়ের চূড়ান্ত অভিযান শুরু করার জন্য প্ররোচিত করে। দাউদ খানের এই আগ্রাসী মনোভাবই সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর অনিবার্য পরিণতি এনে দেয়।

৪. তান্ডা অভিযান ও মুনিম খানের ভূমিকা

সম্রাট আকবর বাংলার অস্থিরতা দমনের জন্য ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে মুনিম খান খান-ই-খানানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। মুনিম খান ছিলেন আকবরের একজন বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি। তিনি প্রাথমিকভাবে বিহার দখল করেন এবং দাউদ খানকে তান্ডার দিকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। তান্ডা, বাংলার তৎকালীন রাজধানী, ছিল দাউদ খানের শেষ দুর্গ। এই অভিযান সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল।

৫. তুকারয়ের যুদ্ধ: একটি নির্ণায়ক সংঘাত

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ, তুকারয় নামক স্থানে মুঘল এবং আফগান বাহিনীর মধ্যে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুঘলরা জয়লাভ করে এবং দাউদ খান পরাজিত হন। তুকারয়ের যুদ্ধ সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর ক্ষেত্রে একটি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধের ফলাফলের পর বাংলার আফগান শক্তি ভেঙে পড়ে।

৬. দাউদ খানের শেষ চেষ্টা ও মুঘলদের চূড়ান্ত বিজয়

তুকারয়ের যুদ্ধে পরাজয়ের পরও দাউদ খান হাল ছাড়েননি। তিনি ওড়িশায় পালিয়ে যান এবং সেখানে নিজেকে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আকবর তাকে অনুসরণ করেন এবং ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খানকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় সম্পূর্ণ হয় এবং বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

৭. মুঘল শাসনের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ: বারো ভুঁইয়াদের প্রতিরোধ

দাউদ খানের পরাজয়ের পর বাংলা সম্পূর্ণভাবে মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় জমিদার, যারা ‘বারো ভুঁইয়া’ নামে পরিচিত ছিল, তারা মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই জমিদাররা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নিজ নিজ অঞ্চলে তাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর পর এই বারো ভুঁইয়াদের দমন করা মুঘলদের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল।

৮. ঈশা খানের নেতৃত্ব ও মুঘলদের দমন অভিযান

বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে ঈশা খান ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যান এবং কয়েকবার মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন। আকবর এই বিদ্রোহ দমনের জন্য বারবার অভিজ্ঞ সেনাপতিদের পাঠান। এই বিদ্রোহ দমন করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। ঈশা খানের এই প্রতিরোধ সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর তাৎক্ষণিক ফল ভোগ করতে মুঘলদের বাধা দেয়।

৯. মানসিংহের ভূমিকা ও সুসংহত শাসন প্রতিষ্ঠা

রাজা মানসিংহ, আকবরের একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি, ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মানসিংহ সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক কৌশলের সমন্বয়ে বারো ভুঁইয়াদের দমন করেন। তিনি অনেক জমিদারকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন এবং অন্যদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মানসিংহের প্রচেষ্টায় সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় বাস্তবে পরিণত হয় এবং বাংলায় মুঘল শাসন সুসংহত হয়।

১০. বাংলার প্রশাসনিক সংস্কার

বাংলা বিজয়ের পর আকবর বাংলায় একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি বাংলাকে কয়েকটি সরকার (জেলা) এবং পরগনায় বিভক্ত করেন। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করা হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে সরাসরি শাসন পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রশাসনিক সংস্কার সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

১১. অর্থনৈতিক প্রভাব: কৃষি ও বাণিজ্যের প্রসার

মুঘল শাসনের অধীনে বাংলায় কৃষি ও বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলার উর্বর ভূমি এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থার কারণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বস্ত্রশিল্প, বিশেষ করে মসলিন, বাংলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর একটি ইতিবাচক দিক ছিল।

১২. সাংস্কৃতিক প্রভাব: বাংলা ভাষার বিকাশ ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা

মুঘল শাসকরা বাংলা ভাষার বিকাশ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকলার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। অনেক পারস্য ও আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে, যা বাংলার ভাষার সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

১৩. স্থাপত্য ও নগরায়ণ

মুঘল শাসনামলে বাংলায় নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে এবং স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটে। অনেক মসজিদ, দুর্গ এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়, যা আজও বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। এই স্থাপত্য নিদর্শনগুলো সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় এর স্থায়ী চিহ্ন বহন করে।

১৪. দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব: আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতন

যদিও সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিল, তবুও দীর্ঘমেয়াদে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে বাংলাতেও স্থানীয় শক্তির উত্থান ঘটে এবং ধীরে ধীরে তারা মুঘলদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। মুর্শিদকুলী খানের সময়ে বাংলা প্রায় স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়।

১৫. উপসংহার: একটি যুগান্তকারী অধ্যায়

সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এই বিজয় কেবল মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তৃতি ঘটায়নি, বরং বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যদিও এই বিজয় রক্তপাত এবং সংঘাতের মধ্য দিয়ে এসেছিল, তবুও এটি বাংলার ইতিহাসকে নতুন পথে পরিচালিত করে এবং এক নতুন যুগের সূচনা করে। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, যা মুঘল শাসনের শক্তিমত্তা এবং দূরদর্শীতার প্রতীক।

বাংলার সুবেদার হিসেবে শায়েস্তা খানের অবদান নিরূপণ কর।

শায়েস্তা খান, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা এবং একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সফল সেনাপতি ও প্রশাসক ছিলেন। তিনি বাংলার সুবেদার হিসেবে দুই দফায় (প্রথম দফায় ১৬৬৪-১৬৭৮ এবং দ্বিতীয় দফায় ১৬৮০-১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ) দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর সুদীর্ঘ শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তাঁর অবদান বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।


বাংলার সুবেদার হিসেবে শায়েস্তা খানের অবদান

শায়েস্তা খানের বাংলার সুবেদার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বাংলা ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অস্থির। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাতে উপকূলীয় অঞ্চল ছিল আতঙ্কগ্রস্ত, এবং অভ্যন্তরীণভাবে শান্তি ও শৃঙ্খলা ছিল বিঘ্নিত। শায়েস্তা খান অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করেন এবং বাংলাকে একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেন।


১. সামরিক অবদান: মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু দমন

শায়েস্তা খানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবদান ছিল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমন করা। এরা আরাকান থেকে এসে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়মিত লুটতরাজ চালাত, যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।

  • চট্টগ্রাম বিজয় (১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ): শায়েস্তা খান ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে একটি সুসংগঠিত নৌ অভিযান পরিচালনা করেন এবং তৎকালীন আরাকানিদের অধীনে থাকা চট্টগ্রাম দখল করেন। এই বিজয়ের ফলে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের মূল ঘাঁটি ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর তিনি এর নামকরণ করেন “ইসলামাবাদ”।
  • নৌবাহিনীর উন্নয়ন: জলদস্যুদের মোকাবেলার জন্য তিনি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি স্থানীয় নৌকা নির্মাতা এবং কারিগরদের উৎসাহিত করেন এবং মুঘল নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেন।
  • শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা: জলদস্যুদের দমনের ফলে বাংলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসে। এর ফলে বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং কৃষকদের মনে স্বস্তি ফিরে আসে।

২. অর্থনৈতিক অবদান: সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা

শায়েস্তা খানের শাসনামল বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য স্মরণীয়। তাঁর উদার নীতি এবং সুশাসনের কারণে বাংলার অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল।

  • জনপ্রিয় “টাকায় আট মণ চাল” প্রবাদ: শায়েস্তা খানের শাসনামলের সবচেয়ে পরিচিত দিক হলো তাঁর সময়ে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক কম হওয়া। কথিত আছে যে তাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, যা তৎকালীন সময়ে অবিশ্বাস্য ছিল। এটি মূলত তাঁর সুষ্ঠু প্রশাসন, উন্নত কৃষি উৎপাদন এবং বাণিজ্যের প্রসারের ফল।
  • কৃষি উন্নয়ন: তিনি কৃষকদের উৎসাহিত করেন এবং ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনেন। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়।
  • বাণিজ্যের প্রসার: শায়েস্তা খান দেশীয় ও বিদেশি বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বণিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেন। এর ফলে বাংলার মসলা, বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: তাঁর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক নীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছিল।

৩. প্রশাসনিক ও সামাজিক অবদান

শায়েস্তা খান একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। তিনি বাংলার প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করেন এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখেন।

  • আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: তিনি কঠোর হাতে অপরাধ দমন করেন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে চুরি, ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধ কমে আসে এবং সাধারণ মানুষ নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে।
  • ন্যায়বিচার: শায়েস্তা খান ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেন। তিনি নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করেন এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন: তিনি সড়ক, সেতু এবং অন্যান্য জনহিতকর স্থাপনা নির্মাণে ভূমিকা রাখেন, যা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়ক হয়।
  • ইসলামী সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা: শায়েস্তা খান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন এবং তিনি অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ঢাকার লালবাগ কেল্লার পরী বিবির মাজার এবং শায়েস্তা খান মসজিদ তাঁর স্থাপত্য প্রীতির নিদর্শন।

৪. শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার

শায়েস্তা খান বাংলার সুবেদার হিসেবে প্রায় ২৪ বছর দায়িত্ব পালন করেন, যা মুঘল সুবেদারদের মধ্যে দীর্ঘতম। তাঁর শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে একটি স্বর্ণালী অধ্যায় হিসেবে পরিচিত, যখন বাংলা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী ছিল। তাঁর সময়ে স্থাপিত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি পরবর্তীকালে বাংলার উন্নতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল।


উপসংহার

শায়েস্তা খানের অবদান বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। তাঁর দূরদর্শিতা, সামরিক বিচক্ষণতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাংলাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনি শুধু একজন সফল সেনাপতি ছিলেন না, বরং একজন জনদরদী শাসকও ছিলেন, যিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর শাসনামল বাংলার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে, যেখানে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন একীভূত হয়েছিল।

আপনার কি শায়েস্তা খানের অন্য কোনো দিক সম্পর্কে জানতে চান?

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *