মানব প্রকৃতি সম্পর্কে রুশোর ধারণা কর্ণনা কর
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে রুশোর ধারণা কর্ণনা কর মানব প্রকৃতি সম্পর্কে…
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে রুশোর ধারণা কর্ণনা কর
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে রুশোর ধারণা কর্ণনা কর
জাঁ জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau) ছিলেন ১৮শ শতকের একজন খ্যাতনামা ফরাসি দার্শনিক ও সমাজচিন্তাবিদ, যিনি ফরাসি বিপ্লব ও আধুনিক গণতন্ত্রের চিন্তায় গভীর প্রভাব রেখেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Social Contract ও Discourse on the Origin and Basis of Inequality among Men–এ মানব প্রকৃতি (human nature) সম্পর্কে একটি মৌলিক ও বিপ্লবাত্মক ধারণা উপস্থাপন করেন। রুশোর মতে, মানুষের প্রকৃতি মূলত শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন এবং নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ, কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা মানুষকে বিকৃত করে তোলে।
✅ রুশোর মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত মূল ধারণাসমূহ:
১. মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ভালো
রুশো বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ জন্মগতভাবে সত্, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি —
“Man is born free, but everywhere he is in chains.”
এই কথায় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ জন্মায় স্বাধীনভাবে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো তাকে দাসত্বে আবদ্ধ করে ফেলে।
২. প্রাকৃতিক অবস্থা (State of Nature)
রুশোর মতে, সভ্যতা-পূর্ব অবস্থা বা প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল মানুষের প্রকৃত রূপ বোঝার সঠিক সময়।
- এই অবস্থায় মানুষ ছিল স্বনির্ভর, সহজ সরল এবং সহিংসতাবিহীন।
- তখনকার মানুষের প্রয়োজন সীমিত ছিল এবং সহানুভূতি বা pity ছিল তার স্বাভাবিক গুণ।
- মানুষ নিজে বাঁচত এবং অন্যকেও বাঁচতে দিত — এটি ছিল তার সহজাত নৈতিকতা।
৩. সমাজই মানুষের অবক্ষয়ের মূল
রুশোর দৃষ্টিতে, সমাজ ও সম্পত্তির ধারণার আবির্ভাব মানুষের প্রকৃতিকে নষ্ট করে দেয়।
- মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও লোভের দাস হয়ে ওঠে।
- প্রতিযোগিতা, হিংসা, অহংকার, বৈষম্য এবং পরনির্ভরতা সমাজের সৃষ্টি — যা প্রকৃত অবস্থায় ছিল না।
৪. আত্মমর্যাদা বনাম আত্মপ্রদর্শন
রুশো বলেন, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষে ছিল amour de soi (আত্মমর্যাদা) — যা স্বাভাবিক, আত্মরক্ষামূলক এবং ইতিবাচক।
কিন্তু সমাজে এসে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে amour-propre (আত্মপ্রদর্শন) — অর্থাৎ অহং, অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রতিযোগিতা, যা হিংসা ও দুর্নীতির জন্ম দেয়।
৫. নৈতিকতা সমাজের পরে আসা বিকৃত ধারণা নয়
রুশোর মতে, নৈতিকতা মানুষের অন্তর্জাত অনুভূতি, তবে সভ্যতা যখন মানুষকে কৃত্রিম রীতিনীতির মধ্যে ফেলে, তখন প্রকৃত নৈতিকতাও বিকৃত হয়ে পড়ে।
এ কারণে তিনি একটি নৈতিক সমাজ ও গণমুখী রাষ্ট্র গঠনের জন্য “সামাজিক চুক্তি”র মাধ্যমে ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে “সাধারণ ইচ্ছা”র (general will) সাথে মিলিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
✅ উপসংহার
রুশোর মতে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন, সহানুভূতিশীল ও ভালো। সমাজ, সম্পত্তি ও কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান তাকে লোভী, আত্মকেন্দ্রিক ও প্রতিযোগিতামুখী করে তোলে। তাই প্রকৃত মানবমুক্তির পথ হলো — ব্যক্তিকে স্বাভাবিক অবস্থার ন্যায় স্বাধীনতা ও সমতার পরিবেশে ফিরিয়ে আনা, যেখানে সে নিজের ও সমাজের প্রকৃত মঙ্গলের জন্য কাজ করতে পারে। রুশোর এই চিন্তা আধুনিক সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।