১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা আলোচনা কর

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা আলোচনা…

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা আলোচনা কর

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে শাসনতন্ত্রের ধারাবাহিক বিবর্তনে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল সবচেয়ে বিস্তৃত ও গভীর প্রভাববিস্তারকারী আইন। এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের সর্ববৃহৎ সাংবিধানিক দলিল, যার মাধ্যমে প্রাদেশিক স্তরে স্বায়ত্তশাসনের সূচনা ঘটে। এ আইনের মাধ্যমে উপনিবেশিক শাসনে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধের একটি সীমিত সুযোগ দেওয়া হয় ভারতীয় রাজনীতিকদের।

এই প্রবন্ধে আমরা ১৫টি মূল পয়েন্টের মাধ্যমে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করব।


১. দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা (Diarchy) বিলুপ্ত

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রদেশগুলো থেকে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর ফলে প্রদেশগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রম এককভাবে নির্বাচিত মন্ত্রিসভার মাধ্যমে পরিচালিত হতো, যা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের একটি বাস্তব রূপ প্রদান করে।


২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মৌলিক স্বীকৃতি

এই আইনে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ সরকার প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসনের একটি সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান করে। অর্থাৎ, নির্বাচিত মন্ত্রীরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পেতেন।


৩. নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন

আইন অনুযায়ী, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রাদেশিক আইন পরিষদ গঠিত হতো। এতে করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন জনগণের ক্ষমতায়নের একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করে।


৪. প্রাদেশিক প্রশাসনে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব

নির্বাচিত ভারতীয় সদস্যরা শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পান। এতে ভারতীয় রাজনীতিকরা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেন এবং রাজনৈতিক চর্চার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।


৫. ব্রিটিশ গভর্নরের কর্তৃত্ব বজায়

যদিও স্বায়ত্তশাসনের ধারণা দেওয়া হয়েছিল, তবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন গভর্নরের হাতে কিছু বিশেষ ক্ষমতা সংরক্ষিত রাখে, যা কার্যত অনেক সময় নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকে খর্ব করত।


৬. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ

এই আইনে পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলমান, শিখ, দলিতসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা ছিল, যা প্রাদেশিক রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।


৭. প্রশাসনিক দক্ষতা ও দায়িত্ববোধের বিকাশ

নির্বাচিত মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজ সামলাতেন, যার ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বনির্ভর নেতৃত্ব গড়ে উঠতে থাকে। এটি ছিল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের একটি কার্যকর দিক।


৮. কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাফল্য

১৯৩৭ সালের নির্বাচন অনুযায়ী কংগ্রেস ৮টি প্রদেশে সরকার গঠন করে, যা আইনটির কার্যকারিতা প্রমাণ করে। এতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব প্রাদেশিক শাসনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।


৯. রাজনৈতিক সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রাদেশিক স্তরে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। জনগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে, যার ফলে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসার লাভ করে।


১০. আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ

এই আইনের আওতায় প্রাদেশিক আইনসভা গঠিত হয়, যেখানে ভারতীয় সদস্যরা আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এটি রাজনৈতিক পরিণতির উন্মেষে সহায়ক হয়।


১১. প্রশাসনের ভারতীয়করণ

এই আইনের ফলে প্রদেশগুলোতে ভারতীয়দের প্রশাসনিক পদে নিয়োগ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এই প্রসঙ্গে একটি গেমচেঞ্জার।


১২. মহারাজাদের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা

আইনটি যদিও ব্রিটিশ ভারতের জন্য প্রযোজ্য ছিল, তবে দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর এর প্রয়োগ হয়নি। ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কিছুটা সীমিত ছিল এবং সামগ্রিক জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি।


১৩. রাজ্যপালের বিশেষ ক্ষমতা

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী রাজ্যপাল বা গভর্নর ‘Discretionary Powers’ ও ‘Special Responsibilities’ ভোগ করতেন। ফলে নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত অনেক সময় বাতিল করা যেত, যা কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করত।


১৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রস্তুত

এই আইন যতই সীমিত হোক না কেন, এটি জাতীয়তাবাদীদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা দেয়। এটি ভবিষ্যতে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি কার্যকর মঞ্চ তৈরি করে দেয়।


১৫. আইনটির সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা

যদিও এটি স্বায়ত্তশাসনের পথ খুলে দেয়, তবুও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ভারতীয়দের হাতে দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশ শাসকের হস্তক্ষেপ, বিভাজনের নীতি, এবং রাজ্যপালের ক্ষমতা এই আইনের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।


উপসংহার

সার্বিকভাবে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের একটি সীমিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ধাপ। এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চর্চা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। যদিও এতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি, তবুও এটি ছিল স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরির এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

প্রদেশভিত্তিক নির্বাচন, মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব, আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ, সংখ্যালঘুদের স্বীকৃতি—এই সব মিলিয়ে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ভারতীয় রাজনীতির এক বাস্তব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র। এর কার্যকারিতা বিচার করলে আমরা বুঝতে পারি, এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংবিধানিক প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Degree suggestion Facebook group

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *