বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তোমার ধারণা ব্যাখ্যা কর
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তোমার ধারণা ব্যাখ্যা…
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তোমার ধারণা ব্যাখ্যা কর
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এর কার্যকর রূপায়নে এখনও কিছু জটিলতা ও সম্ভাবনার সমন্বয়ে এগিয়ে চলছে। এখানে আমরা বিশ্লেষণ করবো “সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা”– এই প্রসঙ্গে। বর্তমান সময়ে এ বিষয়টি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর বাস্তবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একইসাথে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং উন্নয়নের প্রচুর সম্ভাবনাও রয়েছে। এখন আলোচনা করা যাক সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ক ১৫টি মূল দিক।
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব
সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা আলোচনায় প্রথম সমস্যা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, বর্জনমূলক রাজনীতি এবং হরতাল-অবরোধের মতো কার্যক্রম সংসদীয় ব্যবস্থাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২. দলীয় স্বার্থের আধিপত্য
সংসদে অনেক সময় দলীয় স্বার্থ জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে। এতে সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক কমে যায় এবং সংসদীয় গণতন্ত্র তার মূল উদ্দেশ্য হারায়। একে বলা যায়, “সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র”।
৩. বিরোধী দলের ভূমিকার দুর্বলতা
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে প্রায়শই বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে, যার ফলে সরকার একক সিদ্ধান্তে আইন পাস করে। এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়টিকে সংকটের দিকে ঠেলে দেয়।
৪. সংসদ সদস্যদের দক্ষতার অভাব
অনেক সংসদ সদস্যের মধ্যে আইন প্রণয়নে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও আগ্রহের অভাব রয়েছে। এর ফলে কার্যকর আইন প্রণয়ন ব্যাহত হয় এবং জনগণের আস্থা নষ্ট হয়।
৫. সংসদে জবাবদিহিতার ঘাটতি
সংসদে মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকলেও তা কার্যকরভাবে পরিচালিত হয় না। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণে জবাবদিহিতার অভাব একটি বড় সমস্যা।
৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারক নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতা এই ব্যবস্থাকে দুর্বল করে।
৭. প্রশাসনের দলীয়করণ
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ সরকারকে একনায়কতান্ত্রিক আচরণে উৎসাহিত করে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কিত আলোচনায় নেতিবাচক দিক হিসেবে চিহ্নিত।
৮. নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাব একটি বড় সমস্যা। নির্বাচন কমিশনের কার্যকরতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়।
৯. দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতি
রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব, পেশিশক্তির ব্যবহার ও দুর্নীতির বিস্তার সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিরূপণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব কমে যায়।
১০. মিডিয়ার স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ
সংসদীয় গণতন্ত্রে গণমাধ্যম চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাংবাদিকদের দমন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহার এবং মালিকানায় কেন্দ্রীয়করণ সমস্যার সৃষ্টি করে।
১১. সম্ভাবনা: জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার সুযোগ
সংসদীয় ব্যবস্থার মূল শক্তি হলো মন্ত্রিসভার সংসদের কাছে দায়বদ্ধতা। এই ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি সরকারের কার্যক্রমের হিসাব চাইতে পারে, যা সুশাসনের সম্ভাবনা তৈরি করে।
১২. আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণমূলক সুযোগ
সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের মতামত, চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ থাকে। এটি জনগণ ও রাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটায়।
১৩. স্থানীয় সরকারের বিকাশ
সংসদীয় গণতন্ত্রে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়। এতে জনগণ সরাসরি সেবা ও উন্নয়ন প্রকল্পে অংশ নিতে পারে।
১৪. রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ
সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বের পরিবর্তন নিশ্চিত করে। এতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রে গতিশীলতা আসে। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা আলোচনায় বড় সম্ভাবনার দিক।
১৫. নাগরিক সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ
বিগত বছরগুলোতে নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোটাধিকার প্রয়োগ, নাগরিক আন্দোলন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়তা গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে জোরদার করছে।
উপসংহার
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা সমান্তরালভাবে বিদ্যমান। একদিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা সংসদীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে, অন্যদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার সম্ভাবনাও আছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন, শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের বিকাশ এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক মনোভাব গড়ে তোলা। একমাত্র এই পথেই সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা মোকাবিলা করে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব।