বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা কর
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি জটিল…

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এই অভ্যুদয়ের পেছনে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে এ জাতি একটি নতুন পরিচিতি লাভ করে। নিচে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো।
১. প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলাদেশের ইতিহাস শুরু হয় প্রাচীন বাংলার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়। মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল রাজবংশের শাসন বাংলার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। এই সময়েই বাংলা একটি সমৃদ্ধ সভ্যতায় পরিণত হয়।
২. মধ্যযুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা
মুসলিম শাসনের আগমনের পর মধ্যযুগে বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সুলতানি এবং মুঘল শাসন বাংলার ভাষা, সাহিত্য এবং স্থাপত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
৩. ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এবং এর প্রভাব
১৭৫৭ সালের প্লাসি যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ শাসন বাংলার কৃষি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি করে এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি পায়। তবে এর বিপরীতে, স্বাধীনতার চেতনা আরও দৃঢ় হয়।
৪. বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উত্থান স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু বাঙালি লেখক ও কবি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
৫. বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তির সময় বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক দাবি উপেক্ষিত হয়। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের শাসনকাঠামো বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
৬. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে বাঙালিরা প্রবল প্রতিবাদ জানায়। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক প্রমুখের আত্মত্যাগ বাংলা ভাষার জন্য লড়াইকে সফল করে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতিগত পরিচিতি ও স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি করে।
৭. আর্থ-সামাজিক বৈষম্য
পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। শিল্প, শিক্ষা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে পশ্চিম পাকিস্তান অগ্রাধিকার পায়, যা পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ায়।
৮. ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন
ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন তীব্র হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জোরদার করে।
৯. ৬-দফা আন্দোলন ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬-দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন।
১০. ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এই ঘটনা স্বাধীনতার পথে একটি বড় ধাক্কা দেয়।
১১. ৭ মার্চের ভাষণ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বাঙালিদের প্রস্তুত থাকতে বলেন এবং “যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা” করার আহ্বান জানান।
১২. ২৫ মার্চের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” চালিয়ে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। এই নৃশংসতা বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্দীপ্ত করে।
১৩. মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনী একসঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার একটি কৌশলগত ভূমিকা পালন করে।
১৪. আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ভারতীয় সহযোগিতা
ভারত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
উপসংহার
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সামাজিক ও ঐতিহাসিক সংগ্রামের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা বাঙালির স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। এই সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের প্রজন্মের জন্য শিক্ষার উৎস এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের প্রেরণা।
ডিগ্রি সমাজবিজ্ঞান ৬ষ্ঠ পত্র এর সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে এখানে দেখুন