সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক দেখাও।
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক দেখাও। সাম্য ও স্বাধীনতা হলো…
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক দেখাও।
সাম্য ও স্বাধীনতা হলো আধুনিক গণতন্ত্রের দুটি অপরিহার্য স্তম্ভ, যাদের ছাড়া কোনো প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। যদিও প্রথম দর্শনে এই দুটি ধারণা কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী বলে মনে হতে পারে, বাস্তব অর্থে সাম্য ও স্বাধীনতা গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন, এবং একটির অনুপস্থিতি অন্যটির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন সমাজে মৌলিক সাম্য বিদ্যমান থাকে।
সাম্য ও স্বাধীনতা: সম্পর্ক – পরিপূরক নাকি বিরোধী?
ঐতিহাসিকভাবে কিছু চিন্তাবিদ (যেমন লর্ড অ্যাকটন) বিশ্বাস করতেন যে অতিরিক্ত সাম্য ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং স্বাধীনতাকে খর্ব করে। আবার, চরম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (পুঁজিবাদ) সমাজে মারাত্মক বৈষম্য সৃষ্টি করে, যা সাধারণ মানুষের জন্য স্বাধীনতা ভোগ করা কঠিন করে তোলে। তবে, আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারণায়, অধ্যাপক লাস্কি ও অন্যান্য চিন্তাবিদগণ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর পরিপূরক।
সাম্য ও স্বাধীনতা কেন একে অপরের জন্য অপরিহার্য, তা নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়:
১. স্বাধীনতার ভিত্তি হলো সাম্য: সমাজে যদি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকে, তবে দরিদ্র মানুষের পক্ষে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা কার্যকরভাবে ভোগ করা সম্ভব হয় না। সাম্য সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে সবাই স্বাধীনতা লাভের সমান সুযোগ পায়।
২. ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ: লাস্কির মতে, স্বাধীনতা হলো এমন এক পরিবেশ, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটাতে পারে। আর সাম্য নিশ্চিত করে যে, সেই বিকাশের সুযোগ যেন সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত থাকে। অর্থাৎ, সাম্য স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়।
৩. আইনের দৃষ্টিতে সাম্যতা: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্য অপরিহার্য। যখন সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান, তখনই তারা নির্বিঘ্নে তাদের মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। আইনের এই সাম্য নিশ্চিত না হলে, স্বাধীনতা কেবল ক্ষমতাশালীদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যায়।
৪. অর্থনৈতিক সাম্য ও স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক সাম্য বলতে চরম ধনবন্টন নয়, বরং ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর এবং শোষণের হাত থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা বোঝায়। এই ন্যূনতম সাম্য না থাকলে মানুষ জীবনধারণের তাগিদেই তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৫. বিশেষ সুবিধার অনুপস্থিতি: প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ হলো বিশেষ সুবিধার অনুপস্থিতি। অর্থাৎ, কেউ জন্মগতভাবে বা সম্পদগত কারণে বাড়তি সুবিধা পাবে না। এই ধরনের সাম্যই নিশ্চিত করে যে স্বাধীনতা সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
৬. স্বাধীনতার অর্থবহতা: সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা কেবল একটি “কাগজের অধিকার” হয়ে থাকে। যখন একজন দরিদ্র মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বিচার লাভের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, তখন তার স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই সাম্য স্বাধীনতার ধারণাটিকে অর্থবহ করে তোলে।
৭. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়ই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। একটি সমাজে যখন সাম্য বিরাজ করে, তখন মানুষ স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়, যা গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করে।
উপসংহার
সুতরাং, সাম্য ও স্বাধীনতা শুধু পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একটি সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এরা হাত ধরাধরি করে চলে। একটি ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রে, সরকার এবং সমাজের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এই দুইয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা। যেখানে সাম্য নিশ্চিত করবে সমাজের দুর্বল অংশ যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে ব্যক্তির স্বকীয়তা ও আত্ম-বিকাশ যেন কোনোভাবেই খর্ব না হয়। এই ভারসাম্যই একটি উন্নত রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজের পরিচায়ক।

