রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কারসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কারসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ভূমিকা উনবিংশ…
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কারসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
ভূমিকা
উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাসে রাশিয়ার অবস্থান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া তখনও স্বৈরশাসিত সাম্রাজ্য হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (১৮৫৫-১৮৮১ খ্রি.) রাজ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার চালু করেন। ইতিহাসবিদরা তাকে প্রায়শই “Liberator Tsar” বা মুক্তিদাতা সম্রাট নামে উল্লেখ করেন। কারণ তার সময়ে কৃষিদাস মুক্তি, বিচারব্যবস্থা সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, সামরিক সংস্কার এবং স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার রাশিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের পথে নিয়ে গিয়েছিল।
কৃষিদাস মুক্তি (Emancipation of Serfs)
দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল ১৮৬১ সালের কৃষিদাস মুক্তির আইন। রাশিয়ায় তখন প্রায় ৪ কোটি কৃষিদাস ভূমির মালিকদের অধীনে দাসত্বের মতো জীবন যাপন করত। এই ব্যবস্থা কৃষি উৎপাদন ও সামাজিক উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় ছিল।
- এই আইনে কৃষকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
- তারা ভূমি ক্রয় করতে পারলেও এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা বইতে হত।
- ফলে কৃষকরা স্বাধীনতা পেলেও প্রকৃত অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি।
তবুও এই উদ্যোগ ছিল বিশাল এক সামাজিক বিপ্লব। ইতিহাসবিদরা একে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার এর কেন্দ্রবিন্দু মনে করেন।
বিচারব্যবস্থার সংস্কার
১৮৬৪ সালে আলেকজান্ডার বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার চালান। আগের রাশিয়ান আদালত ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অস্বচ্ছ। নতুন ব্যবস্থায়:
- স্বাধীন আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- জুরি প্রথা চালু করা হয়।
- আইনের সামনে সকলকে সমান ধরা হয়।
- বিচারকদের বেতন বাড়িয়ে তাদের দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা হয়।
এই পদক্ষেপ জনগণের আস্থা অর্জন করে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে তোলে।
শিক্ষা সংস্কার
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার এর মধ্যে শিক্ষার প্রসার অন্যতম। তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও মুক্তচিন্তার সুযোগ বাড়ানো হয়। যদিও সরকারের কড়া সেন্সরশিপ থাকায় পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া যায়নি, তবুও জ্ঞানের আলো ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে থাকে।
সেনাবাহিনী সংস্কার
১৮৭৪ সালে তিনি সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। আগে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ ২৫ বছরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ দেওয়া হতো। নতুন সংস্কারে:
- বাধ্যতামূলক সেনা সেবার মেয়াদ কমিয়ে ৬ বছর করা হয়।
- এরপর রিজার্ভ ডিউটিতে রাখা হতো।
- শিক্ষিত শ্রেণির জন্য কিছু ছাড় দেওয়া হয়।
এর ফলে সেনাবাহিনী ছোট হলেও দক্ষ ও আধুনিক হয়ে ওঠে।
স্থানীয় স্বশাসন বা জেমস্তভো (Zemstvo)
১৮৬৪ সালে তিনি গ্রামীণ পর্যায়ে জেমস্তভো নামে স্থানীয় স্বশাসনের ব্যবস্থা চালু করেন। এতে সাধারণ মানুষ স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিতে পারত। যদিও অভিজাত শ্রেণি প্রভাবশালী ছিল, তবুও এটি রাশিয়ার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
শিল্প ও অর্থনৈতিক সংস্কার
রেলপথ নির্মাণ, ব্যাংক ব্যবস্থা ও শিল্পোন্নয়নে জোর দেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। তার আমলে রাশিয়ার শিল্প খাত ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়। কৃষিদাস মুক্তির ফলে শ্রমশক্তি শহরে আসতে শুরু করে এবং নতুন কারখানা গড়ে ওঠে। এই পদক্ষেপগুলো রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার এর অর্থনৈতিক দিককে প্রতিফলিত করে।
সেন্সরশিপ শিথিলকরণ
যদিও তিনি পূর্ণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেননি, তবুও আগের তুলনায় কিছুটা উদার নীতি গ্রহণ করেন। সংবাদপত্র ও বই প্রকাশের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়, ফলে বুদ্ধিজীবী সমাজ আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ পায়।
পোল্যান্ড নীতি
পোল্যান্ডে বিদ্রোহ দমন করে আলেকজান্ডার কঠোর পদক্ষেপ নিলেও কিছু সীমিত সংস্কার চালু করেন। তবে সেখানে তার নীতি মূলত ছিল দমনমূলক। তাই পোল্যান্ডবাসীরা তাকে ইতিবাচকভাবে দেখেনি।
সংস্কারের সীমাবদ্ধতা
যদিও রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার ছিল বিপ্লবাত্মক, তবুও এর সীমাবদ্ধতা ছিল স্পষ্ট।
- কৃষকরা প্রকৃত অর্থে ভূমির মালিক হতে পারেনি।
- স্থানীয় স্বশাসন অভিজাতদের দখলে ছিল।
- সেন্সরশিপ পুরোপুরি উঠেনি।
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুব সীমিত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ঘটনা
১৮৮১ সালে একদল বিপ্লবী সংগঠন তার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করে। মজার বিষয় হলো, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তিনি আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কার চালুর পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মৃত্যুতে রাশিয়ার সংস্কার প্রক্রিয়া অনেকটাই থেমে যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা থেকে বের করে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের সূচনা করে। যদিও সংস্কারগুলো অসম্পূর্ণ ছিল, তবে এগুলো ভবিষ্যৎ রাশিয়ার রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করেছিল।
উপসংহার
সংক্ষেপে বলতে গেলে, দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের শাসনামলে রাশিয়া ছিল পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে। তার উদ্যোগে কৃষিদাস মুক্তি, বিচারব্যবস্থা সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, সামরিক পরিবর্তন এবং স্থানীয় স্বশাসনের সূচনা ঘটে। এই সমস্ত পদক্ষেপ মিলে ইতিহাসে তাকে এক বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। যদিও সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা আছে, তবুও রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার উনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার আধুনিকায়নের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।