মাযহাব বলতে কী বুঝ? মাযহাব কয়টি ও কী কী? বৈশিষ্ট্যসহ বর্ণনা কর।
ইসলামী জীবন পরিচালনার জন্য শরিয়তের মৌলিক সূত্র কুরআন ও হাদীস। তবে সময় ও সমাজের বাস্তবতায় কিছু মাসআলা বা সমস্যার সমাধান এসব মৌলিক উৎস থেকে সরাসরি পাওয়া কঠিন হয়। এসব ক্ষেত্রে ইসলামী স্কলারগণ স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। এই পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ ও চিন্তাধারার ধারাকে বলা হয় মাযহাব। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা জানব মাযহাব বলতে কী বুঝি, মাযহাব কয়টি ও কী কী, এবং প্রতিটি মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
মাযহাব বলতে কী বুঝ?
মাযহাব শব্দটি আরবি “ذهب” ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো “চলা” বা “পথ অনুসরণ করা”। ইসলামী পরিভাষায় মাযহাব বলতে বুঝায়—একজন বিজ্ঞ আলেম বা মুজতাহিদের পক্ষ থেকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে গঠিত এক সংগঠিত শরিয়ত ভিত্তিক মতবাদ, যা নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
মাযহাব কেবল মতামতের নাম নয়, বরং এটি একটি বিশ্লেষণভিত্তিক আইনী কাঠামো, যার মাধ্যমে ইসলামী বিধানগুলোকে বুঝা, প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ করা হয়। মাযহাব মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে – ইবাদত, লেনদেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
মাযহাব কয়টি ও কী কী?
ইসলামী শরীয়তের মূল চারটি মাযহাব সর্বাধিক সুপরিচিত ও স্বীকৃত। এই চারটি মাযহাব হলো:
- হানাফি মাযহাব
- মালিকি মাযহাব
- শাফেয়ি মাযহাব
- হাম্বলি মাযহাব
এই চারটি মাযহাবই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহ্র অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিটি মাযহাব কুরআন ও হাদীসকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামি আইন প্রণয়ন করেছে।
হানাফি মাযহাব
প্রতিষ্ঠাতা:
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) (৮০ হিজরি – ১৫০ হিজরি)
বৈশিষ্ট্য:
- যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ ও কিয়াস (তুলনা) ব্যবহারে অগ্রগামী।
- ‘ইস্তিহসান’ পদ্ধতির প্রয়োগে প্রসিদ্ধ।
- অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অনুসৃত, যেমন: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, আফগানিস্তান প্রভৃতি।
মাযহাবের অবদান:
হানাফি মাযহাব ইসলামী ফিকহশাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত এবং এর অনুসারী সংখ্যায় সর্বাধিক। এটি ইবাদত, লেনদেন, ফৌজদারি আইন, পারিবারিক বিধানসহ প্রতিটি বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়।
মালিকি মাযহাব
প্রতিষ্ঠাতা:
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) (৯৩ হিজরি – ১৭৯ হিজরি)
বৈশিষ্ট্য:
- মদীনার আমলকে (Amal Ahl al-Madinah) প্রমাণ হিসেবে গ্রহণে অগ্রগামী।
- হাদীসের ব্যাপক সংরক্ষণ এবং প্রয়োগে দৃঢ় অবস্থান।
- ইস্তিসলাহ (সর্বজনকল্যাণ) পদ্ধতির গুরুত্ব প্রদান।
মাযহাবের প্রচলন:
মূলত উত্তর আফ্রিকা, মিশর, সুদান, মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় মালিকি মাযহাব অনুসৃত।
শাফেয়ি মাযহাব
প্রতিষ্ঠাতা:
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফেয়ি (রহ.) (১৫০ হিজরি – ২০৪ হিজরি)
বৈশিষ্ট্য:
- কুরআন ও সহিহ হাদীসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান।
- কিয়াস এবং ইজমা পদ্ধতির ব্যবহার সুসংহতভাবে।
- ইলমে উসূলুল ফিকহ (ফিকহের মৌলনীতি) চর্চায় ইমাম শাফেয়ির অবদান অপরিসীম।
অনুসারী অঞ্চল:
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিশরের কিছু অংশ, দক্ষিণ ভারতের কিছু অঞ্চল ইত্যাদি।
হাম্বলি মাযহাব
প্রতিষ্ঠাতা:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) (১৬৪ হিজরি – ২৪১ হিজরি)
বৈশিষ্ট্য:
- কুরআন ও হাদীসের উপর সবচেয়ে কঠোরভাবে নির্ভরশীল।
- কিয়াস ও রায় প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা।
- দুর্বল হাদীসকে কিয়াসের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া।
প্রচলন:
সৌদি আরব, কাতার এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু এলাকায় হাম্বলি মাযহাব অনুসৃত।
মাযহাব অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা
১. সঠিক পথনির্দেশ:
মাযহাব মুসলমানদের জন্য শরীয়তের বিশুদ্ধ ও বিশ্লেষণমূলক দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
২. বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা:
নিজস্ব ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর না করে, মাযহাব অনুসরণের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ও ভুল সিদ্ধান্ত এড়ানো যায়।
৩. ফিকহের ঐতিহ্য সংরক্ষণ:
প্রতিটি মাযহাব ইসলামী ফিকহশাস্ত্রের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রক্ষা ও বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।
মাযহাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য কেন?
চারটি মাযহাবের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও তা মূলত ব্যাখ্যার পদ্ধতিগত পার্থক্য। তারা সবাই কুরআন ও হাদীসের প্রতি আনুগত্যশীল, কিন্তু প্রমাণ যাচাই ও বিশ্লেষণের ধরণ আলাদা। যেমন:
- কেউ কেউ ইজমাকে অগ্রাধিকার দেয়, আবার কেউ মদিনাবাসীর প্রথা অনুসরণে অগ্রগামী।
- কেউ ইস্তিহসানকে গ্রহণ করে, কেউ করে না।
তবে সকল মাযহাবই সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার শিক্ষা দেয়। তাই একজন মুসলমানের উচিত—নিজ মাযহাব মেনে চলা ও অন্য মাযহাবকে সম্মান করা।
মাযহাব নিয়ে ভুল ধারণা
অনেকে মনে করেন, মাযহাব মানে ভিন্ন ধর্ম বা বিভক্তি। এটি সম্পূর্ণ ভুল। মাযহাব হচ্ছে শরিয়ত ব্যাখ্যার পথ—যা আল কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে গড়ে ওঠে। একাধিক মাযহাব থাকলেও ইসলাম এক ও অভিন্ন। মাযহাবভিত্তিক পার্থক্য মতবাদের ভিন্নতা, মূল আকীদায় নয়।
মাযহাব পরিবর্তন করা কি জায়েজ?
ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, ব্যক্তি মাযহাব পরিবর্তন করতে পারেন—যদি তা প্রকৃত জ্ঞান, প্রয়োজন ও বিশুদ্ধ নিয়তের ভিত্তিতে হয়। তবে ফতোয়া গ্রহণ ও আমলকে অস্থিরভাবে বদলানো উচিত নয়। তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। একজন মুসলমানের উচিত—একটি স্বীকৃত মাযহাবের অনুসরণে দৃঢ় থাকা।
বর্তমান যুগে মাযহাবের ভূমিকা
আধুনিক যুগের নতুন নতুন সমস্যা ও প্রেক্ষাপটে মাযহাবসমূহ আমাদের শরিয়তের আলোকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম। মাযহাব ভিত্তিক ফতোয়া, কোর্ট আইন, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
মাযহাবভিত্তিক ঐক্য ও সৌহার্দ্য
মাযহাব ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তার মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করা অনুচিত। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখতে হলে পারস্পরিক সহনশীলতা, সম্মান ও সহমর্মিতা অপরিহার্য।
উপসংহার
মাযহাব হলো ইসলামী ফিকহশাস্ত্রের গঠিত পথ, যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনার উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দেয়। হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি – এই চারটি মাযহাব ইসলামী বিশ্বে সমানভাবে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য। প্রতিটি মাযহাবের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, জ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যার পদ্ধতি ও ঐতিহাসিক অবদান। মাযহাব মানেই ইসলাম নয়, বরং মাযহাব হচ্ছে ইসলামের সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ চর্চার মাধ্যম। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত—মাযহাব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা, তা সম্মানের সাথে অনুসরণ করা এবং অন্যান্য মাযহাবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।