সাওম কত প্রকার ও কী কী? সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের বিধান বর্ণনা কর।

সাওম কত প্রকার ও কী কী? সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের বিধান বর্ণনা কর।

সাওম কত প্রকার ও কী কী? সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের বিধান

ভূমিকা

ইসলামে ইবাদতের মধ্যে সাওম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। মুসলমানদের জন্য সাওম পালন করা ফরজ, যা তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়। আরবি শব্দ “সাওম” (صوم) এর অর্থ আত্মসংযম বা বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে এর অর্থ নির্দিষ্ট নিয়মে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার ও নিষিদ্ধ কার্যাদি থেকে বিরত থাকা। এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে — সাওম কত প্রকার ও কী কী এবং সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের বিধান সম্পর্কে বিশদভাবে।


সাওম কত প্রকার ও কী কী?

ইসলামী শরীয়তে সাওম প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত:

১. ফরজ সাওম

ফরজ সাওম হলো রমযান মাসে রোজা রাখা। এটি প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মুসলমানের জন্য আবশ্যক।

‌উল্লেখযোগ্য দিক:

  • রমযানের সাওম কোরআন দ্বারা ফরজ হয়েছে (সূরা বাকারা: ১৮৩)।
  • এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি।
  • রমযানের প্রতিটি দিনের সাওম পালন না করলে গোনাহে কবিরা হয়।

২. নফল সাওম

ফরজ সাওম ছাড়া অন্যান্য অতিরিক্ত ইচ্ছাকৃত রোজাগুলোকেই বলা হয় নফল সাওম। এগুলো পালন করলে সওয়াব হয় এবং না রাখলেও গোনাহ হয় না।

‌নফল সাওমের কিছু উদাহরণ:

  • আশুরার সাওম (১০ই মহররম ও তার পূর্ব/পরবর্তী দিন)
  • আরাফার সাওম (হজের ৯ জিলহজ্জ)
  • শবানে রোযা
  • সোম ও বৃহস্পতিবারের সাওম
  • শওয়ালের ছয়টি রোযা
  • দাউদ (আ.) এর রোযা (একদিন রোযা রেখে পরদিন ভাঙা)

সাওম এর আরও কিছু প্রকারভেদ

১. কাযা সাওম

রমযানের ফরজ সাওম যদি কোনো বৈধ কারণে রাখা না যায় (যেমন অসুস্থতা, সফর), তবে পরে সেই রোযার বদলি রাখা আবশ্যক, এটিই কাযা সাওম।

২. কাফ্ফারা সাওম

কারো দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে রমযানের সাওম ভেঙে ফেললে তাকে কাফ্ফারা দিতে হয়। এর আওতায় ৬০ দিন ধারাবাহিক রোযা রাখা হয়।

৩. মান্নতের সাওম

কোনো ব্যক্তি মান্নত করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়। যেমন, কেউ বলে “আমার কাজটি হয়ে গেলে আমি ৩ দিন রোযা রাখব”।

৪. কিফফারাহ সাওম

যাদের উপর কিছু নির্দিষ্ট শাস্তিস্বরূপ রোযা রাখা ওয়াজিব হয় — যেমন, ভুলে কসম করে ফেললে।


সাওম এর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

সাওমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংযম, আল্লাহভীতি, ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। সাওম মানুষকে দুনিয়াবি মোহ ও ভোগবিলাস থেকে বিরত রাখে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়। এটি ধৈর্য, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার প্রকৃষ্ট অনুশীলন। সাওম রাখার মাধ্যমে গরীব-দুঃখীর কষ্ট অনুধাবন করা যায়।


সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ

সাওম ভঙ্গ হয় এমন কিছু কাজ করা হারাম। এর মধ্যে অন্যতম:

  • ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করা
  • রমযানের দিনে সহবাস করা
  • বমি করে ফেলা (ইচ্ছাকৃতভাবে)
  • ঋতুবতী নারীর রোযা রাখা
  • নাফরমানিতে লিপ্ত হওয়া

সাওম ভেঙে গেলে করণীয়

সাওম ভেঙে গেলে দুই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়:

১. বৈধ কারণে সাওম ভেঙে গেলে:

যেমন – অসুস্থতা, মাসিক, সফর ইত্যাদি। তখন শুধু কাযা সাওম আদায় করলেই হয়।

২. অকারণে বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙলে:

তখন কাফ্ফারা আদায় করতে হয়।


সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের বিধান

কাফ্ফারার কারণ

রমযানের ফরজ সাওম ইচ্ছাকৃতভাবে ভঙ্গ করলে কাফ্ফারা আবশ্যক হয়। যেমন:

  • জেনে-বুঝে খাওয়া বা পান করা
  • সহবাস করা
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে ফেলা

কাফ্ফারার ধরন ও আদায় পদ্ধতি

কাফ্ফারার জন্য তিনটি ধাপ রয়েছে:

১. একটি দাস মুক্ত করা (যদি সম্ভব হয়)

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাস প্রথা নেই, তাই এটি প্রযোজ্য নয়।

২. ধারাবাহিকভাবে ৬০ দিন রোযা রাখা

  • একদিনও ভাঙা চলবে না।
  • অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার পরে আবার পূর্ণ ৬০ দিন শুরু করতে হবে।

৩. যদি ৬০ দিন রোযা রাখতে না পারে, তবে ৬০ জন মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করা

  • প্রতিজনের জন্য এক কিলোগ্রাম গম বা তার সমমূল্যের খাদ্য দিতে হবে।
  • একসাথে বা আলাদাভাবে দেওয়া যায়।

সাওম এর কাফ্ফারা সংক্রান্ত ফিকহি মতামত

  • হানাফি মাজহাবে কাফ্ফারার ৬০ দিনের রোযা একটানা রাখা জরুরি।
  • ইমাম মালেক (রহ.)-এর মতে সহবাসই মূলত কাফ্ফারার কারণ।
  • অন্য কোনো গোনাহর জন্য কাফ্ফারা নয়, কেবল ফরজ সাওম ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙার কারণেই কাফ্ফারা আবশ্যক হয়।

নারী ও রুগ্নদের ক্ষেত্রে কাফ্ফারা

নারীরা যদি রমযানে জেনে-বুঝে সাওম ভেঙে ফেলেন, তবে তাদের উপরও কাফ্ফারা আবশ্যক। কিন্তু যদি মাসিক, সন্তান জন্মদানের মতো প্রাকৃতিক কারণে ভাঙে, তবে কেবল কাযা আদায় করলেই যথেষ্ট। তদ্রূপ, রোগীর ক্ষেত্রেও যদি রোযা না রাখার বৈধতা থাকে, তবে কাফ্ফারার দরকার হয় না।


বাচ্চা ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিধান

যারা বালেগ হয়নি, তাদের উপর সাওম ফরজ নয়। তারা যদি সাওম ভঙ্গ করে, তবে কাফ্ফারা আদায় করতে হয় না।


সাওম না রাখা ও কাফ্ফারা না দেওয়া – পরিণতি

সাওম ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেলা এবং কাফ্ফারা না দেওয়া ইসলামically গুরুতর অপরাধ। এটি গোনাহে কবিরা হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য আল্লাহর নিকট তাওবা করতে হবে এবং কাফ্ফারা অবশ্যই আদায় করতে হবে। না করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।


সাওম এর কাফ্ফারা আদায়ের সময়

  • কাফ্ফারা আদায় দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত।
  • কাযা ও কাফ্ফারা একত্রে রাখা যাবে না।
  • রমযান আসার আগেই পূর্বের সাওম ও কাফ্ফারা সম্পন্ন করা উচিত।

উপসংহার

সাওম ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আত্মসংযমের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহৎ উপায়। রমযানের সাওম ফরজ এবং এটি পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। সাওম ভেঙে গেলে কাযা ও কাফ্ফারার বিধান রয়েছে যা প্রতিটি মুসলমানকে জানা আবশ্যক। সঠিকভাবে সাওম পালন ও কাফ্ফারা আদায়ের মাধ্যমেই একজন মুসলমান প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করতে পারেন। সাওম কেবল উপবাস নয়, এটি এক আত্মিক শুদ্ধির অনুশীলন, যা মুসলমানদের নৈতিকতা ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তোলে।


Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment