কোন কোন পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ এবং কোন কোন পানি দ্বারা নয় তা বর্ণনা কর।

কোন কোন পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ এবং কোন কোন পানি দ্বারা নয় তা বর্ণনা কর।

ভূমিকা

ইসলামে পবিত্রতা বা তাহারাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, ইবাদতের নানা ক্ষেত্রে শরীর ও বস্তুর পবিত্রতা অপরিহার্য। আর এই তাহারাত অর্জনের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় উপাদান হলো পানি। কিন্তু সব ধরনের পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়। তাই ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন কোন পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ এবং কোন পানি দ্বারা নয়, তা জানা অত্যন্ত জরুরি।

এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—ইসলামী শরিয়তের আলোকে কী কী পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ, আবার কী কী পানি দ্বারা তা অবৈধ। এর মাধ্যমে একজন মুসলিম ব্যক্তি নিজের দৈনন্দিন ইবাদত আরও শুদ্ধভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন।


১. তাহারাত ও পানির সম্পর্ক

তাহারাত অর্থ পবিত্রতা অর্জন। শরীয়তের দৃষ্টিতে, ওজু, গোসল বা কাপড় ও শরীর পরিষ্কার করার জন্য শর্ত হলো পবিত্র পানি। আর এই পবিত্র পানি নির্ধারণে রয়েছে কিছু শর্ত ও সীমাবদ্ধতা। তাই এটি বোঝা জরুরি যে, শুধু পানি হলেই চলবে না, বরং যেসব পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ, সেগুলোর বৈশিষ্ট্যও নির্ধারিত।


২. তাহারাত অর্জন বৈধ যেসব পানির দ্বারা

ক. বৃষ্টির পানি

বৃষ্টির পানি প্রকৃতিগতভাবে পবিত্র এবং এর দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ। কুরআনে বলা হয়েছে:

“আর আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি।” (সূরা আল-ফুরকান: ৪৮)

খ. নদীর পানি

নদীর পানিও প্রবাহমান ও বিশুদ্ধ হওয়ায় এর দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ। এটি বৃষ্টির পানিরই একটি অংশ এবং চলমান থাকার কারণে এতে পবিত্রতা বজায় থাকে।

গ. সাগর বা সমুদ্রের পানি

রাসূল (সা.) সমুদ্রের পানি সম্পর্কে বলেছেন,

“তার পানি পবিত্র এবং তার মৃত জীবজন্তু হালাল।” (তিরমিযী)

অতএব, সাগরের পানির দ্বারাও তাহারাত অর্জন বৈধ

ঘ. ঝরনা ও ঝর্ণার পানি

প্রাকৃতিকভাবে ঝরনা বা ঝর্ণা থেকে আসা পানিও পবিত্র এবং এ দ্বারা ওজু ও গোসল করা যায়।

ঙ. কূপের পানি

যদি কোনো কূপের পানি বিশুদ্ধ থাকে এবং তাতে নাপাক কিছু না পড়ে, তাহলে সেটি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ। নবী (সা.) তাঁর সময়ে কূপের পানি ব্যবহার করতেন।

চ. বরফ গলা পানি ও শিশির

বরফ গলে গেলে বা শিশির জমে যে পানি হয়, তা প্রাকৃতিক ও বিশুদ্ধ। তাই এ দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ

ছ. খাল-বিল বা হ্রদের পানি

যদি তা নাপাক বস্তু মুক্ত থাকে এবং তার রং, গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তন না হয়, তাহলে এই পানির দ্বারাও তাহারাত অর্জন বৈধ


৩. যেসব পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়

ক. নাপাক পানি

যে পানিতে নাপাক বস্তু পড়েছে এবং তা দ্বারা তার রং, গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তিত হয়েছে, সে পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়।

খ. ব্যবহৃত পানি (ماء مستعمل)

যে পানি দ্বারা কেউ ওজু বা গোসল করেছে এবং সেটি পুনরায় সংরক্ষিত হয়ে গেছে, তা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এই ধরনের পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়।

গ. ফুলের নির্যাস বা রঙিন পানি

যদি কোনো পানিতে গোলাপ, চন্দন বা অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্য মিশিয়ে তা দিয়ে গোসল বা ওজু করা হয়, তাহলে তা দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়। কারণ এতে পানির মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়।

ঘ. রক্ত, মদ বা পশুর মল-মূত্র মিশ্রিত পানি

এইসব নাপাক পদার্থ পানিতে পড়লে এবং তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফেলে, তাহলে এমন পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়।

ঙ. ময়লা পানির পুকুর

যেসব পুকুরে নিয়মিত বর্জ্য ফেলা হয় কিংবা আবর্জনা জমে থাকে এবং তার ফলে রং, গন্ধ বা স্বাদ বদলে যায়, সে পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়।


৪. পানির বৈশিষ্ট্য যা তাহারাতের জন্য অপরিহার্য

তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখা হয়:

  1. রং: পানির রং স্বাভাবিক থাকা চাই।
  2. গন্ধ: পানিতে কোনো দুষিত গন্ধ থাকা চলবে না।
  3. স্বাদ: পানির স্বাদ পরিবর্তিত হলে তা দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়।

যদি উপরোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যের কোনোটিতে পরিবর্তন আসে নাপাকির কারণে, তাহলে তা দ্বারা আর তাহারাত অর্জন বৈধ থাকবে না।


৫. অল্প ও বেশি পানির মাঝে পার্থক্য

ইসলামী শরিয়তে পানি দু’ভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়:

  • অল্প পানি: দুই কুল্লার চেয়ে কম (প্রায় ২০ লিটার)। এতে কোনো নাপাক বস্তু পড়লে তা পবিত্র থাকে না।
  • বেশি পানি: দুই কুল্লার বেশি। তাতে কোনো কিছু পড়লেও যদি বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন না হয়, তবে তা পবিত্র থাকে এবং তাহারাত অর্জন বৈধ হয়।

৬. জরুরি অবস্থায় পানির বিকল্প

যদি কোথাও পবিত্র পানি না পাওয়া যায়, তাহলে ইসলাম তায়াম্মুম করার সুযোগ দিয়েছে। এটি ইসলামের দয়া ও সহজতার একটি নিদর্শন।

তবে যখনই পানি পাওয়া যাবে, তখন তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে এবং পবিত্র পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ হবে।


৭. ইজতিহাদ ও আধুনিক বাস্তবতা

আধুনিক যুগে অনেকেই বোতলজাত পানি, ফিল্টার পানি বা ওয়াটার পিউরিফায়ারের মাধ্যমে পানি ব্যবহার করেন। যদি এই পানিগুলোতে কোনো নাপাক দ্রব্য না থাকে এবং মৌলিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে, তাহলে তা দ্বারাও তাহারাত অর্জন বৈধ


৮. সাধারণ ভুল ধারণা

অনেকে মনে করেন, সুগন্ধি পানি বা সাবান মেশানো পানি দ্বারা ওজু করা উত্তম। এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ পানির মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হলে তাহারাত অর্জন অবৈধ হয়ে যায়।


৯. তত্ত্ব ও আমলের সমন্বয়

শুধু পানির ধরন জানলেই চলবে না, বরং তা বাস্তবে প্রয়োগে মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিদিনের নামাজ, রোযা, তাওয়াফ, হজ – সব ইবাদতের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা। এজন্য পানির ব্যবহারে সচেতনতা অপরিহার্য।


১০. ফতোয়া ও মতভেদ

বিভিন্ন মাজহাব বা ফিকহি মতবাদের মাঝে পানির ব্যবহার নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। কিন্তু মূল নীতি একই: পানির মৌলিক বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকলে তাহারাত অর্জন বৈধ হয়। তাই নিজের মাজহাব অনুযায়ী নির্ভুল ফতোয়ার দিকেই অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়।


উপসংহার

ইসলাম একটি পরিচ্ছন্ন ধর্ম। তা শুধু অন্তরের পরিচ্ছন্নতা নয়, বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতাকেও গুরুত্ব দেয়। তাই পানি দ্বারা তাহারাত অর্জন করা ইসলামের মৌলিক অংশ। তবে সব ধরনের পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ নয়। এ বিষয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা এবং সঠিকভাবে তা পালন করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।

যেসব পানির দ্বারা তাহারাত অর্জন বৈধ, তা বুঝে ব্যবহার করলে আমাদের ইবাদত হবে বিশুদ্ধ, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য এবং আত্মিক শান্তি অর্জন করা সম্ভব হবে। অপরদিকে, ভুল পানি ব্যবহারে ইবাদতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

অতএব, আসুন, শরিয়তের নির্ধারিত পানি ব্যবহার করে তাহারাত অর্জনের মাধ্যমে আমরা পবিত্র জীবনযাপন নিশ্চিত করি।

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment