মৌসুমী বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্বের শ্রেণিবিভাগ ও কারণসমূহ বিশ্লেষণ কর।

মৌসুমী বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্বের শ্রেণিবিভাগ ও কারণসমূহ বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা:

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য বেকারত্ব একটি গুরুতর এবং বহুমুখী সমস্যা। এটি কেবল ব্যক্তিগত দুর্দশার কারণ নয়, বরং সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথেও একটি বড় বাধা। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, এর বিভিন্ন দিক, যেমন – প্রকারভেদ, কারণ এবং প্রভাব – পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা মৌসুমী বেকারত্বের ধারণা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বেকারত্বের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ এবং এর মূল কারণসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” সমস্যাটির একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে সাহায্য করবে।

মৌসুমী বেকারত্ব কি?

মৌসুমী বেকারত্ব হলো এক ধরনের বেকারত্ব যা নির্দিষ্ট ঋতু বা সময়ের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওঠানামার কারণে সৃষ্টি হয়। সহজ কথায়, কিছু শিল্প বা খাত বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং অন্য সময়ে কর্মসংস্থান হ্রাস করে। এর ফলে সেই শিল্পের শ্রমিকরা বছরের কিছু সময় বেকার থাকেন। কৃষি, পর্যটন, নির্মাণ শিল্প এবং ফিশিং শিল্পে মৌসুমী বেকারত্ব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের কৃষি খাতে ফসল কাটা বা বুননের মৌসুমে শ্রমিকের চাহিদা বেশি থাকে, কিন্তু অন্যান্য সময়ে শ্রমিকের চাহিদা কমে যায়, যার ফলে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে মৌসুমী বেকারত্বকে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশের বেকারত্বের শ্রেণিবিভাগ:

“বাংলাদেশের বেকারত্ব”কে মূলত কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়, যা এর প্রকৃতি ও কারণ বুঝতে সাহায্য করে:

  1. সংঘাতমূলক বেকারত্ব (Frictional Unemployment): এটি হলো এক ধরনের স্বল্পকালীন বেকারত্ব যা কর্মসংস্থান পরিবর্তন বা নতুন কর্মসংস্থান খোঁজার সময় ঘটে। যখন একজন ব্যক্তি একটি চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরির সন্ধানে থাকে অথবা সদ্য স্নাতক হয়ে প্রথম চাকরির সন্ধান করে, তখন এই ধরনের বেকারত্ব দেখা যায়। এটি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক অংশ এবং “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি নিয়মিত উপাদান।
  2. কাঠামোগত বেকারত্ব (Structural Unemployment): এটি ঘটে যখন শ্রমবাজারের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এর কারণ হতে পারে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, শিল্পের স্থানান্তর, অথবা শ্রমিকদের দক্ষতার অভাব। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি শিল্প আধুনিক প্রযুক্তির দিকে ধাবিত হয় এবং শ্রমিকরা সেই প্রযুক্তিতে দক্ষ না হয়, তাহলে তারা কাঠামোগতভাবে বেকার হয়ে পড়বেন। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর ক্ষেত্রে কাঠামোগত সমস্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  3. চাক্রিক বেকারত্ব (Cyclical Unemployment): এটি অর্থনৈতিক মন্দা বা মন্দার সময় ঘটে যখন সামগ্রিক চাহিদা কমে যায় এবং কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়। অর্থনীতির চক্রাকার উত্থান-পতনের সাথে এর সম্পর্ক বিদ্যমান। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর উপর বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা প্রায়শই প্রভাব ফেলে।
  4. মৌসুমী বেকারত্ব (Seasonal Unemployment): পূর্বে উল্লিখিত হিসাবে, এটি ঋতুভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে ঘটে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি বড় অংশ মৌসুমী বেকারত্ব দ্বারা প্রভাবিত।
  5. ছদ্মবেশী বেকারত্ব (Disguised Unemployment): এই ধরনের বেকারত্বে মনে হয় কর্মসংস্থান আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক লোক একটি কাজে নিযুক্ত থাকে, যেখানে তাদের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য বা প্রায় শূন্য। কৃষি খাতে এটি বিশেষভাবে দেখা যায়, যেখানে একটি ছোট জমিতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পারিবারিক সদস্য কাজ করে। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি সূক্ষ্ম কিন্তু ব্যাপক দিক এটি।
  6. স্বেচ্ছামূলক বেকারত্ব (Voluntary Unemployment): এটি ঘটে যখন একজন ব্যক্তি বিদ্যমান মজুরি হারে কাজ করতে ইচ্ছুক নয় এবং আরও ভালো কাজের জন্য অপেক্ষা করে। এটি তার নিজস্ব পছন্দের উপর নির্ভরশীল।
  7. শিক্ষিত বেকারত্ব (Educated Unemployment): উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরেও যখন কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত কাজ খুঁজে পায় না, তখন তাকে শিক্ষিত বেকারত্ব বলা হয়। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি উদ্বেগজনক দিক এটি, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক কর্মহীন থাকছেন।

বাংলাদেশের বেকারত্বের কারণসমূহ বিশ্লেষণ:

“বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর সমস্যাটি একক কোনো কারণে সৃষ্ট নয়, বরং এটি বহুবিধ জটিল উপাদানের সম্মিলিত ফলাফল। নিচে এর প্রধান কারণগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হলো:

  1. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি বছর শ্রমবাজারে বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মী প্রবেশ করে, কিন্তু পর্যাপ্ত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না। এটি “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর অন্যতম প্রধান কারণ।
  2. শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের অভাব: দেশের শিল্প খাতের ধীরগতি এবং পর্যাপ্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অভাব নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় বাধা। ছোট ও মাঝারি শিল্প (SME) খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব, যা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমাতে সাহায্য করবে।
  3. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা: বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ। তাত্ত্বিক জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে অনেক স্নাতক কর্মজীবনে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে ভুগেন। ফলে শিক্ষিত বেকারত্বের হার বাড়ছে, যা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
  4. কৃষি খাতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা: বাংলাদেশ এখনও একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিখাতে মৌসুমী কর্মসংস্থান বিদ্যমান এবং এটি ছদ্মবেশী বেকারত্বেরও কারণ। কৃষিখাতের আধুনিকীকরণ এবং শিল্পখাতের বিকাশে জোর না দিলে “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমানো কঠিন।
  5. প্রযুক্তিগত পরিবর্তন: আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন – স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা – কিছু ক্ষেত্রে শ্রমের চাহিদা কমিয়ে দেয়। যেসব শ্রমিক এই প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেন না, তারা বেকার হয়ে পড়েন। এটিও “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি কারণ।
  6. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সুশাসনের অভাব: রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সুশাসনের অভাব বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে, যা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দেয়। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমাতে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য।
  7. অবকাঠামোগত দুর্বলতা: বিদ্যুৎ, গ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো মৌলিক অবকাঠামোগত দুর্বলতা শিল্পায়ন ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবে নতুন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হয়, যা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” বৃদ্ধিতে সহায়ক।
  8. উদ্যোক্তা তৈরির অভাব: বাংলাদেশে উদ্যোক্তা তৈরির সংস্কৃতি এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের জন্য পর্যাপ্ত সমর্থন ও সুযোগের অভাব রয়েছে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কমিয়ে দেয়। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি অত্যন্ত জরুরি।
  9. ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা: নতুন ব্যবসা শুরু করতে বা বিদ্যমান ব্যবসাকে প্রসারিত করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রাপ্তি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার এবং জামানত সংক্রান্ত জটিলতা নতুন উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে।
  10. দুর্বল সরকারি নীতিমালা: কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর সরকারি নীতিমালার অভাব “বাংলাদেশের বেকারত্ব” সমস্যার একটি বড় কারণ। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।
  11. নগরায়ণ ও গ্রামীণ বেকারত্ব: গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরে মানুষের মাইগ্রেশন বাড়ছে, কিন্তু শহরগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকায় শহুরে বেকারত্ব বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমানো সম্ভব।
  12. দক্ষ জনশক্তির অভাব: যদিও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি, তবে নির্দিষ্ট কিছু খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগ করে এই শূন্যতা পূরণ করা যেতে পারে। এটি “বাংলাদেশের বেকারত্ব” মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
  13. লিঙ্গ বৈষম্য: কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যও “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর একটি দিক। নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের কম মজুরি দেওয়া হয়।
  14. শ্রমবাজারের অদক্ষতা: শ্রমবাজারের তথ্য প্রবাহে দুর্বলতা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব কর্মপ্রার্থীদের জন্য উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পেতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।
  15. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব: বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা, বাণিজ্য যুদ্ধ বা অন্যান্য অর্থনৈতিক অস্থিরতা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” এর উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে রপ্তানি-নির্ভর শিল্পগুলোতে।

উপসংহার:

“বাংলাদেশের বেকারত্ব” একটি জটিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় বাধা। মৌসুমী বেকারত্ব থেকে শুরু করে কাঠামোগত, চাক্রিক এবং শিক্ষিত বেকারত্ব – প্রতিটি ধরণের বেকারত্বের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত শিল্পায়ন, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিনিয়োগের অভাব এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলায় একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, এবং উদ্যোক্তা তৈরির সংস্কৃতি গড়ে তোলা “বাংলাদেশের বেকারত্ব” কমাতে সহায়ক হবে। একইসাথে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি, যা একটি সুস্থ ও কর্মসংস্থান-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করবে। “বাংলাদেশের বেকারত্ব” মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে পারে।

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment