ফিক্হ শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
🔷 ভূমিকা:
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিধান বা নির্দেশনার প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন থেকেই ইসলামী শরিয়তের একটি মৌলিক শাখা হিসেবে ফিক্হ শাস্ত্র (ইসলামী বিধি-বিধান) গড়ে উঠেছে। “ফিক্হ” শব্দটি আরবি “فِقْهٌ” থেকে এসেছে, যার অর্থ—গভীর জ্ঞান, বোধ ও বোঝাপড়া। মূলত, কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম, আচার-আচরণ ও ইবাদতের নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করাই ফিক্হ শাস্ত্রের কাজ।
🔷 ফিক্হ শাস্ত্রের উৎপত্তি:
১. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ (ইলহামের যুগ):
- ফিক্হের সূচনা হয় স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর দ্বারা। তিনি ওহির আলোকে মানুষকে শরিয়তের বিধান শেখাতেন।
- কুরআন নাজিলের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম আসত।
- হাদীস ও সুন্নাহ ছিল সরাসরি ফিক্হের বাস্তব উদাহরণ।
২. সাহাবায়ে কিরামের যুগ:
- রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবিগণ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ফতোয়া দিতেন।
- কঠিন প্রশ্নে নিজেদের ইজতিহাদ প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
- এই সময়ে ফিক্হ মৌখিকভাবে সংরক্ষিত ছিল, লিখিতভাবে সংগঠিত হয়নি।
🔷 ফিক্হ শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ (ঐতিহাসিক ধাপ):
🔹 ১. তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ:
- সাহাবাদের শিক্ষার্থীরা ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষভাবে চর্চা শুরু করেন।
- কুফা, বসরা, মদীনা, মক্কা, শাম, ইয়ামান প্রভৃতি অঞ্চলে আলাদা আলাদা ফিক্হি চিন্তাধারা গড়ে ওঠে।
- মুখস্থ ও মৌখিক শিক্ষার পাশাপাশি লেখনীতে ফিক্হের সংগঠিত রূপ দেখা যায়।
🔹 ২. চার মাজহাব প্রতিষ্ঠার যুগ (দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরি):
এই যুগে ফিক্হ চর্চা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। চারজন ইমাম তাঁদের মেধা, বিচার-বিশ্লেষণ ও দলিলভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে চারটি প্রধান মাজহাব প্রতিষ্ঠা করেন:
- ইমাম আবু হানিফা (রহ.) – হানাফি মাজহাব
- ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) – মালিকি মাজহাব
- ইমাম আশ-শাফিঈ (রহ.) – শাফেয়ী মাজহাব
- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) – হাম্বলি মাজহাব
✅ এই সময় ফিক্হ একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাস্ত্র রূপে গড়ে উঠে।
🔹 ৩. তালিফ ও তদ্বীন যুগ (চতুর্থ হিজরি থেকে):
- ফিক্হের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বই, সংকলন ও ফতোয়াসমূহ লেখা হয়।
- গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহ:
- আল-হিদায়া (হানাফি)
- আল-মুদাওয়ানা (মালিকি)
- আল-উম্ম (শাফেয়ী)
- আল-মুসনাদ (হাম্বলি)
- ফিক্হ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পড়ানো শুরু হয় (ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, হুদুদ ইত্যাদি)।
🔹 ৪. ইলমুল ফিক্হ ও উসূলুল ফিক্হের বিকাশ:
- উসূলুল ফিক্হ অর্থাৎ ফিক্হের মূলনীতি বা পদ্ধতির বিজ্ঞান রচিত হয়।
- ইমাম শাফেয়ী (রহ.) প্রথম “উসূলুল ফিক্হ” বিষয়ে কিতাব লেখেন — “আর-রিসালা”।
- ফিক্হ শাস্ত্র তখন একটি যুক্তিবাদী, প্রামাণ্য ও তুলনামূলক শাস্ত্র হয়ে ওঠে।
🔹 ৫. মুকাল্লিদ যুগ (ইজতিহাদের স্থবিরতা):
- ইজতিহাদ বন্ধ হতে থাকে, ফকীহগণ পূর্ববর্তী ইমামদের অনুকরণ করতে শুরু করেন।
- ফিক্হ চর্চা সীমিত হয়ে পড়ে চার মাজহাবের মধ্যে।
- নতুন পরিস্থিতিতে ইজতিহাদ কম হয়।
🔹 ৬. আধুনিক যুগে ফিক্হের পুনর্জাগরণ:
- আধুনিক রাষ্ট্র, ব্যাংকিং, চিকিৎসা, বীমা, বিজ্ঞান ইত্যাদি নতুন বিষয়ের উদ্ভব হয়।
- নতুন মাসআলার উত্তর দিতে আধুনিক ফিক্হ একাডেমি, ফতোয়া বোর্ড গঠিত হয়।
- মালয়েশিয়া, মিসর, সৌদি আরব, কাতার, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশে ইসলামী আইন গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠে।
🔷 উপসংহার:
ফিক্হ শাস্ত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলমানদের জীবন পরিচালনার একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন। এর উৎপত্তি মহানবীর যুগে হলেও, ধারাবাহিকভাবে সাহাবা, তাবেঈন, ইমামগণ ও আধুনিক ফকীহদের মাধ্যমে এটি বিকাশ লাভ করেছে। ফিক্হ একটি চিরায়ত ও প্রগতিশীল শাস্ত্র—যা অতীতের শিক্ষা ও বর্তমান চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে গতিশীল রাখে।
Degree suggestion Facebook group
২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর