বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ: একটি বিশদ বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণগুলি বহুবিধ, যার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নত প্রযুক্তির অভাব, অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ও খণ্ড-বিখণ্ড জমি, আধুনিক কৃষি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব, বাজারজাতকরণে সমস্যা, ঋণের অপ্রাপ্যতা, সার ও বীজের উচ্চমূল্য, গবেষণার স্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শ্রমিকের অভাব ও অদক্ষতা, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, নীতি সহায়তা ও সমন্বয়ের অভাব, কৃষিতে বিনিয়োগের স্বল্পতা এবং কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার। এই কারণগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের কৃষি খাতের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এর অর্থনীতি এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যুগ যুগ ধরে কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও, এখনও বহু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান যা দেশের কৃষিকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলিই মূলত কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব কারণের বিস্তারিত আলোচনা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশের কৃষি খাতের অন্যতম প্রধান কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলস্বরূপ সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকদের জীবন ও ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- বন্যা: বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই দেশের বিশাল এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়, যা রোপা আমনসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। আকস্মিক বন্যা অনেক সময় কৃষকের সব স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যা তাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ফেলে দেয়। এটি বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম।
- খরা: উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা দেখা দেয়, যার ফলে ধানের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। পানির অভাবে ফসল শুকিয়ে যায় এবং কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হন।
- লবণাক্ততা: উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং অনেক জমিই কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদী কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে কাজ করছে।
- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস: প্রায়শই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে, যা কৃষকদের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তোলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের প্যাটার্নে পরিবর্তন আসছে, নতুন নতুন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ছে, যা কৃষকদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে এবং দেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
২. উন্নত প্রযুক্তির অভাব
কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম। উন্নত দেশগুলোর কৃষিতে যেখানে উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার সাধারণ ঘটনা, সেখানে বাংলাদেশের কৃষকরা এখনও বহুলাংশে সনাতন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
- আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা: জমি চাষ, ফসল রোপণ, আগাছা দমন, সার প্রয়োগ এবং ফসল কাটার মতো কাজে এখনও অনেক কৃষক হাতে বা সনাতন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেন। যান্ত্রিকীকরণের অভাব উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং সময় নষ্ট করে।
- প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব: অনেক কৃষকের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান নেই। প্রশিক্ষণ এবং প্রদর্শনের অভাবে তারা নতুন প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
- উচ্চমূল্য: আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির উচ্চমূল্যও একটি বড় বাধা। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে এসব যন্ত্র ক্রয় করা সম্ভব হয় না।
আধুনিক প্রযুক্তি যেমন – উচ্চফলনশীল বীজ, উন্নত সেচ পদ্ধতি, ড্রোন প্রযুক্তি, সেন্সরভিত্তিক কৃষি ইত্যাদির ব্যবহার কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু এর অভাবই কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
৩. অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা
সারা দেশে সেচ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা এবং অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের কৃষি মূলত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। তবে শুষ্ক মৌসুমে এবং বৃষ্টির অভাবে সেচের প্রয়োজন হয়।
- ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা: অধিকাংশ সেচ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি করছে।
- নদী ও খালের নাব্যতা হ্রাস: দেশের অনেক নদী ও খালের নাব্যতা কমে যাওয়ায় বা শুকিয়ে যাওয়ায় ভূপৃষ্ঠের পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ছে। পলি জমা এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব জলাশয় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
- অপরিকল্পিত সেচ: অনেক স্থানে অপরিকল্পিত সেচের কারণে পানি অপচয় হয় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা ফসলের ক্ষতি করে।
একটি সমন্বিত এবং টেকসই সেচ ব্যবস্থার অভাব বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম।
৪. ক্ষুদ্র ও খণ্ড-বিখণ্ড জমি
বাংলাদেশের কৃষিজমিগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং খণ্ড-বিখণ্ড। উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ভাগ হতে হতে অনেক পরিবারে জমির পরিমাণ এত কম হয়ে গেছে যে বাণিজ্যিক কৃষিকাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
- ছোট আয়তন: অধিকাংশ কৃষকের জমির পরিমাণ খুবই কম। এতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কঠিন হয় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
- খণ্ড-বিখণ্ডতা: একই কৃষকের জমি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, যা তত্ত্বাবধানে সমস্যা তৈরি করে এবং যাতায়াত খরচ বাড়ায়।
- জমির সদ্ব্যবহারের অভাব: ক্ষুদ্র আকারের কারণে জমিতে ফসল আবর্তন বা বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা কঠিন হয়।
জমির এই ক্ষুদ্র ও খণ্ড-বিখণ্ডতা কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে একটি বড় বাধা, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
৫. আধুনিক কৃষি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব
কৃষি সম্প্রসারণ পরিষেবা এবং আধুনিক কৃষি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে একটি প্রধান বাধা। অনেক কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন এবং নতুন জাত, সার বা কীটনাশক ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নন।
- প্রশিক্ষণের অভাব: কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, যেখানে তারা নতুন প্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার, রোগবালাই দমন এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
- কৃষি কর্মকর্তাদের স্বল্পতা: মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় এবং যারা আছেন তাদের পক্ষেও সব কৃষকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
- তথ্য প্রবাহের অভাব: কৃষকদের কাছে কৃষি-সংক্রান্ত সঠিক এবং সময়োপযোগী তথ্যের অভাব রয়েছে।
আধুনিক কৃষি জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়া কৃষকদের পক্ষে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা বা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন, যা বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে কাজ করে।
৬. বাজারজাতকরণে সমস্যা
উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের অভাব বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম। কৃষকরা প্রায়শই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকেন এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না।
- পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা: গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। কাঁচা রাস্তা এবং পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা পণ্য বাজারজাত করতে সমস্যার সম্মুখীন হন।
- সঠিক বাজার তথ্যের অভাব: কৃষকদের কাছে কোন পণ্যের চাহিদা কোথায় বেশি বা কোন সময় কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য থাকে না।
- সংরক্ষণ সুবিধার অভাব: অধিকাংশ কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত গুদাম বা হিমাগার নেই। ফলে পচনশীল পণ্য দ্রুত বিক্রি করে দিতে হয়, যা অনেক সময় লোকসানের কারণ হয়।
- মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য: কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে লাভবান হয়, আর কৃষকরা বঞ্চিত হন। এটি একটি বড় কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
সঠিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা তাদের পরিশ্রমের ফল ঠিকমতো পান না, যা তাদের কৃষিকাজে নিরুৎসাহিত করে।
৭. ঋণের অপ্রাপ্যতা
কৃষি ঋণ প্রাপ্তির জটিলতা এবং অপ্রাপ্যতাও বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। কৃষিকাজ শুরু করার জন্য বা উন্নত প্রযুক্তির জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক কৃষক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজে ঋণ পান না।
- জটিল প্রক্রিয়া: কৃষি ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া অনেক সময় জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হয়, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
- জামানতের সমস্যা: অনেক কৃষকের কাছে ব্যাংককে দেখানোর মতো পর্যাপ্ত জামানত থাকে না।
- সুদের হার: যদিও সরকারি ব্যাংকগুলোতে কৃষি ঋণের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম, তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা বেশি। অনেক কৃষক চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন।
- ঋণ পরিশোধের চাপ: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ফসলের ক্ষতির কারণে অনেক সময় কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, যা তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলে দেয়।
যথাযথ কৃষি ঋণের অভাব কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে বাধা দেয়, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে কাজ করে।
৮. সার ও বীজের উচ্চমূল্য এবং মান নিয়ে প্রশ্ন
কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং নিম্নমানের বীজ বা সারের সহজলভ্যতাও বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- উচ্চমূল্য: আন্তর্জাতিক বাজারে সার ও বীজের দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশীয় কৃষকদের ওপর পড়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচও বাড়ে, যা সার ও বীজের দামকে প্রভাবিত করে।
- মানের সমস্যা: অনেক সময় বাজারে নিম্নমানের বীজ বা নকল সার পাওয়া যায়, যা ফসল উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কৃষকরা সঠিক মান যাচাই করতে পারেন না এবং প্রতারিত হন।
- সরবরাহ সংকট: সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার বা বীজ না পাওয়ার কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এই সমস্যাগুলো কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং ফলন কমিয়ে দেয়, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
৯. কৃষি গবেষণার স্বল্পতা ও গবেষণার ফলাফল মাঠ পর্যায়ে না পৌঁছানো
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগের স্বল্পতা এবং গবেষণার ফলাফল কৃষকদের কাছে না পৌঁছানোও কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- সীমিত গবেষণা: নতুন জাতের বীজ উদ্ভাবন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।
- গবেষণা ও মাঠের দূরত্ব: গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে নতুন প্রযুক্তি বা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে, তা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর সম্প্রসারণ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে।
- ব্যবহারিক প্রয়োগের অভাব: অনেক সময় গবেষণার ফলাফল কৃষকদের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, ফলে তারা সেগুলো গ্রহণ করেন না।
ফলস্বরূপ, কৃষকরা নতুনত্ব থেকে বঞ্চিত হন এবং পুরোনো পদ্ধতিতেই আটকে থাকেন, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১০. অবকাঠামোগত দুর্বলতা
কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত দুর্বলতাও বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা: গ্রামীণ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে বাধা সৃষ্টি করে।
- বিদ্যুৎ সরবরাহ: কৃষি কাজে সেচ পাম্প চালানোর জন্য পর্যাপ্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক স্থানে বিদ্যুতের অভাবে কৃষকরা সেচ দিতে পারেন না।
- সংরক্ষণাগারের অভাব: পূর্বে উল্লিখিত গুদাম ও হিমাগারের অভাব কৃষকদের পচনশীল পণ্য সংরক্ষণে বাধা দেয়।
এই দুর্বল অবকাঠামো কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং লাভজনকতা অর্জনে বাধা দেয়, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১১. শ্রমিকের অভাব ও অদক্ষতা
কৃষি কাজে আধুনিক পদ্ধতির অনুপস্থিতি এবং কৃষি শ্রমিকের অভাব ও অদক্ষতাও বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- শ্রমিকের অভাব: তরুণ প্রজন্ম কৃষি কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং শহরমুখী হচ্ছে। ফলে কৃষি মৌসুমে শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দেয়।
- অদক্ষতা: অনেক কৃষি শ্রমিক আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অদক্ষ। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হয়।
- উচ্চ মজুরি: শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় তাদের মজুরি বেড়ে যায়, যা কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করে।
শ্রমিকের এই সমস্যা কৃষকদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১২. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পরেও কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে একটি প্রধান হতাশার উৎস।
- বাজারের অস্থিরতা: অনেক সময় চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যের অভাবে কৃষিপণ্যের দাম কমে যায়।
- মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ: মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে পণ্য কিনে বাজারজাত করে বেশি লাভ করেন।
- নীতিমালার অভাব: কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং স্থিতিশীল রাখার জন্য কার্যকর নীতিমালার অভাব রয়েছে।
ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং কৃষি কাজ থেকে বিমুখ হন, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১৩. নীতি সহায়তা ও সমন্বয়ের অভাব
কৃষি নীতি প্রণয়নে দুর্বলতা এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- দুর্বল নীতি: অনেক সময় কৃষকদের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করা হয় না বা তা বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকে।
- সমন্বয়হীনতা: কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়, যা সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বাধা দেয়।
- দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব: স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পভিত্তিক কাজ অনেক সময় কৃষির টেকসই উন্নয়নে ব্যর্থ হয়।
কার্যকর নীতি সহায়তা ও সমন্বয়ের অভাবে কৃষি খাত কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোতে পারে না, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১৪. কৃষিতে বিনিয়োগের স্বল্পতা
সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই কৃষিতে বিনিয়োগের স্বল্পতা বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
- সরকারি বিনিয়োগ: বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে কম। গবেষণায়, সেচ ব্যবস্থায় বা অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হয় না।
- বেসরকারি বিনিয়োগ: কৃষিকাজকে লাভজনক মনে না করায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা করপোরেট বিনিয়োগও কম। ফলে আধুনিক কৃষি খামার বা প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
- উদ্যোক্তাদের অনীহা: নতুন কৃষি উদ্যোগ বা স্টার্টআপে বিনিয়োগের আগ্রহ কম থাকে, কারণ কৃষি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত।
বিনিয়োগের অভাবে আধুনিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি ব্যাহত হয়, যা কৃষি অনগ্রসরতার কারণ।
১৫. কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার বৃদ্ধি
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়নের কারণে কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে, যা বাংলাদেশের কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গুলোর মধ্যে একটি মারাত্মক হুমকি।
- আবাসন: ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতে কৃষি জমি বাড়িঘর নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- শিল্পায়ন: কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহার হচ্ছে।
- অপরিকল্পিত ব্যবহার: অনেক সময় অপরিকল্পিতভাবে জলাভূমি ভরাট করে বা উঁচু জমি কেটে বসতবাড়ি তৈরি করা হয়, যা কৃষিজমি হ্রাস করে।
কৃষিজমি কমে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী কৃষি অনগ্রসরতার কারণ যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে কৃষি অনগ্রসরতার কারণ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। যদিও বাংলাদেশ সরকার কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আরও সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অভিযোজন কৌশল, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, কৃষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সম্প্রসারণ, কার্যকর বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান, এবং কৃষিজমি সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। এসব পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কৃষি খাত আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।