অগাস্টিনের ‘দুই রাষ্ট্র’ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর

অগাস্টিনের ‘দুই রাষ্ট্র’ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর


সেন্ট অগাস্টিনের পার্থিব রাষ্ট্র ও বিধাতার রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ তাঁর বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ “The City of God” (De Civitate Dei)-এ বিশদভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই মতবাদে তিনি মানব সমাজকে দুটি বিপরীতমুখী রাষ্ট্র বা নগরে ভাগ করেন—বিধাতার রাষ্ট্র (City of God) এবং পার্থিব রাষ্ট্র (City of Man)। নিচে ধারাবাহিকভাবে অগাস্টিনের এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করা হলো:

🔶 ১. তত্ত্বের পটভূমি

৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোম নগরী বর্বর গোত্র ভিসিগথদের হাতে পতিত হলে, অনেকেই রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্মকে দায়ী করেন। এই প্রেক্ষাপটে অগাস্টিন তাঁর “দুই নগরের তত্ত্ব” বা “দুটি রাষ্ট্রের মতবাদ” গড়ে তোলেন। এই তত্ত্বে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, পৃথিবীর ঘটনাবলী ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ, এবং পার্থিব রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও বিধাতার রাজ্য চিরস্থায়ী।


🔶 ২. দুটি রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্য

বিষয়বিধাতার রাষ্ট্র (City of God)পার্থিব রাষ্ট্র (City of Man)
ভিত্তিঈশ্বরের প্রেম, আত্মত্যাগ ও বিশ্বাসআত্মপ্রেম, অহংকার ও ভোগ
লক্ষ্যপরকালীন মুক্তি ও চিরন্তন শান্তিপার্থিব সুখ, ক্ষমতা ও গৌরব
নাগরিকঈশ্বরবিশ্বাসী, ধার্মিক ও নৈতিক ব্যক্তিধর্মহীন, আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী ব্যক্তি
সময়কালচিরন্তন ও অবিনাশীক্ষণস্থায়ী ও বিলুপ্তিযোগ্য
প্রতিনিধিত্বখ্রিস্টীয় গির্জা ও বিশ্বাসী সমাজপার্থিব সরকার ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমাজ

🔶 ৩. মানব ইতিহাসে দুই রাষ্ট্রের সংঘাত

অগাস্টিন বলেন, মানব জাতির ইতিহাস মূলত এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস। আদিপাপে (Original Sin) পতনের ফলে মানুষ নিজেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পার্থিব রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে। অপরদিকে, ঈশ্বরের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আনুগত্য যাঁরা বজায় রাখেন, তাঁরা বিধাতার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হন।


🔶 ৪. বিধাতার রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

  • এটি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক রাজ্য।
  • এর নাগরিকরা ঈশ্বরের নির্দেশ মেনে চলে।
  • এটি পার্থিব রাজ্যের চেয়ে উচ্চতর, কারণ এর লক্ষ্য চিরন্তন মুক্তি।
  • এর মধ্যে আছে আত্মত্যাগ, করুণা, বিনয় ও ঈশ্বরপ্রেম।

🔶 ৫. পার্থিব রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

  • এটি মানুষের অহংকার, লোভ ও জাগতিক আকাঙ্ক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
  • এতে ন্যায়বিচার অনুপস্থিত হলে তা “ডাকাতদের জোট” (band of robbers)-এর মতো হয়ে ওঠে।
  • যুদ্ধ, দম্ভ, শক্তি ও রাজনীতির জটিলতা এর প্রধান অস্ত্র।

🔶 ৬. ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক

অগাস্টিন বলেন, পার্থিব রাষ্ট্র ও বিধাতার রাষ্ট্র কখনো কখনো একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য আলাদা। খ্রিস্টান নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি পার্থিব কর্তৃপক্ষ মান্য করবে, তবে তার চূড়ান্ত আনুগত্য থাকবে ঈশ্বরের প্রতি।


🔶 ৭. শাসক ও আইন সম্পর্কে অগাস্টিনের দৃষ্টিভঙ্গি

  • সত্যিকারের ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র নয়।
  • আইন যদি ঈশ্বরপ্রদত্ত নৈতিকতার ভিত্তিতে গঠিত না হয়, তবে তা অবিচার প্রতিষ্ঠা করে।
  • রাজা বা শাসক যদি ঈশ্বরভীরু না হন, তবে তার শাসন মুল্যহীন।

🔶 ৮. বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা

অগাস্টিন বিশ্বাস করেন, পার্থিব রাষ্ট্রের আইন ও বিচার যদি ঈশ্বরের নীতির পরিপন্থী হয়, তবে তা মানুষকে সত্যিকারের মুক্তি দিতে পারে না। বিধাতার রাষ্ট্রই একমাত্র প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।


🔶 ৯. শেষ বিচারের দিন ও দুই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ

অগাস্টিন বলেন, ইতিহাসের এক পর্যায়ে ঈশ্বর চূড়ান্ত বিচার করবেন। তখন বিধাতার রাষ্ট্রের নাগরিকরা চিরন্তন মুক্তি লাভ করবে এবং পার্থিব রাষ্ট্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই বিশ্বাসে খ্রিস্টানরা অনুপ্রাণিত হন সৎপথে চলতে।


🔶 ১০. সমসাময়িক তাৎপর্য

অগাস্টিনের এই তত্ত্ব আধুনিক রাজনীতি, নৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় মতবাদে প্রভাব ফেলেছে। তাঁর চিন্তা ধর্ম ও রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারণে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে মধ্যযুগীয় ইউরোপে চার্চ ও রাজ্য আলাদা করার ভিত্তি এটি গড়ে দেয়।


✅ উপসংহার

সেন্ট অগাস্টিনের “পার্থিব রাষ্ট্র ও বিধাতার রাষ্ট্র” সম্পর্কিত মতবাদ মানব ইতিহাস, রাজনীতি এবং নৈতিকতার এক গভীর ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। এই তত্ত্ব মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, পার্থিব গৌরব ও ক্ষমতা অস্থায়ী, আর পরম শান্তি ও মুক্তির পথ শুধুমাত্র ঈশ্বরের পথে। একজন খ্রিস্টান নাগরিক হিসেবে তার প্রকৃত দায়িত্ব হলো—পার্থিব রাষ্ট্রে বাস করেও বিধাতার রাষ্ট্রের নীতিমালা অনুযায়ী জীবনযাপন করা। এই দ্বৈত দায়িত্বই অগাস্টিনীয় রাষ্ট্রদর্শনের মূল মর্মবাণী।

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment