চাকমা এথনিক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনধারা আলোচনা কর।
চাকমা এথনিক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনধারা আলোচনা কর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত…
চাকমা এথনিক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনধারা আলোচনা কর।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৃহত্তম আদিবাসী বা এথনিক গোষ্ঠী হলো চাকমা। মূলত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় এদের বসবাস। এদের স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং জীবনধারা বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবনধারা মূলত তাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ, ভাষা, ধর্ম এবং উৎসবের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
১. সামাজিক কাঠামো এবং সংগঠন
চাকমা সমাজ ব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে একটি সুসংগঠিত কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। এদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক এবং বংশগতভাবে পরিচালিত।
- পরিবার: চাকমা সমাজের মূল ভিত্তি হলো পরিবার, যা প্রধানত একক পরিবার (Nuclear Family) হলেও বর্ধিত পরিবারের (Extended Family) ধারণাও প্রচলিত আছে। পিতা বা স্বামী পরিবারের কর্তা হিসেবে বিবেচিত হন।
- সমাজপতি বা কার্বারি: ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি চাকমা গ্রাম বা ‘আদাম’-এর প্রধানকে বলা হয় কার্বারি। কার্বারিরা গ্রামের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে হেডম্যান বা সার্কেলের প্রধানের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন।
- হেডম্যান ও রাজা: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমাদের একটি সুসংগঠিত প্রথাগত প্রশাসনিক ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় একটি মৌজা, যার প্রধান হলেন হেডম্যান। চাকমা মৌজাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত চাকমা সার্কেলের প্রধান হলেন চাকমা রাজা, যিনি প্রথাগত আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতীক। তবে আধুনিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও এখানে বিদ্যমান।
- বিবাহ ব্যবস্থা: চাকমা সমাজে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রথা। সাধারণত পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে পাণি চাওয়া (চুমুনি বা চুমাচাওয়া) প্রথা প্রচলিত। যৌতুক প্রথার পরিবর্তে এখানে পণ দেওয়ার রেওয়াজ আছে, যদিও এটি এখন শিথিল হচ্ছে। বিধবা বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ সমাজে স্বীকৃত।
২. ধর্মীয় জীবন ও বিশ্বাস
চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রায় শতভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী (থেরবাদ)। তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ ধর্মের গভীর প্রভাব রয়েছে।
- পূজা ও উৎসব: প্রতিটি গ্রামে বৌদ্ধ বিহার (কেয়াং) এবং ভিক্ষু থাকেন। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় তিথি ও উৎসব পালন করেন, যেমন— বুদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান (যা ভিক্ষুদের জন্য বিশেষ বস্ত্র তৈরির উৎসব), এবং মাঘী পূর্ণিমা।
- লোকবিশ্বাস: বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি চাকমারা প্রকৃতির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল এবং বিভিন্ন আত্মা ও অপশক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তারা বন-জঙ্গল, পাহাড়-নদীকে পবিত্র মনে করে এবং পূজা-অর্চনা করে।
৩. সাংস্কৃতিক জীবন ও উৎসব
চাকমাদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যা তাদের পোশাক, খাদ্য, ভাষা ও উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
- ভাষা ও লিপি: চাকমাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা চাকমা ভাষা (বা চাংমা তাং) নামে পরিচিত। এটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিজস্ব লিপিও রয়েছে, যার নাম ‘আকড় পাড়’। তবে বর্তমানে তারা বাংলা ও ইংরেজি লিপিরও ব্যবহার করে।
- পোশাক ও অলংকার: চাকমা নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো পিনন (নিচের অংশ) এবং হাদি (উপরের অংশ)। এটি হাতে বোনা এবং উজ্জ্বল রঙের নকশায় সমৃদ্ধ হয়। পুরুষেরা সাধারণত লুঙ্গি ও শার্ট পরিধান করলেও বিশেষ অনুষ্ঠানে খাদ্যং (মাথায় পরার বস্ত্র) ব্যবহার করে। নারীরা নানা ধরনের রূপা ও পুঁতির অলংকার পরিধান করে।
- প্রধান উৎসব – বিজু: চাকমাদের সবচেয়ে বড় এবং আনন্দময় উৎসব হলো বিজু, যা বাংলা বছরের শেষ দু’দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন ধরে মোট তিন দিন পালন করা হয়।- ফুল বিজু (প্রথম দিন): বাড়ির আশেপাশে ফুল দিয়ে সাজানো হয়।
- মূল বিজু (দ্বিতীয় দিন): এই দিনে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ-মিশালি সবজি দিয়ে তৈরি ‘পাচন’ রান্না করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন করা হয়।
- গোজ্যে-পোজ্যে বা নতুন বছর (তৃতীয় দিন): এই দিনে বয়স্কদের আশীর্বাদ নেওয়া হয় এবং বিহারে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। এই উৎসবে বিজু নৃত্য অত্যন্ত জনপ্রিয়।
 
- নৃত্য ও সঙ্গীত: চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মধ্যে বিজু নাচ, জুম নাচ এবং নানা ধরনের লোকনৃত্য উল্লেখযোগ্য। তাদের নিজস্ব লোকগান, যা গেঙখুলী নামে পরিচিত, খুব জনপ্রিয়। বাঁশি এবং এক ধরনের দোতারা (বেহালা সদৃশ বাদ্যযন্ত্র) তাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।
৪. জীবনধারণের পদ্ধতি (আর্থ-সামাজিক জীবনধারার সংক্ষিপ্ত রূপ)
ঐতিহাসিকভাবে চাকমাদের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল জুম চাষ।
- জুম চাষ: এটি পাহাড়ের ঢালে এক বিশেষ ধরনের স্থান পরিবর্তনশীল কৃষি পদ্ধতি, যেখানে বনের গাছপালা পুড়িয়ে সেই জমিতে ধান, ভুট্টা, তিল ও বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত কারণে বর্তমানে জুম চাষের গুরুত্ব কমে আসছে।
- বিকল্প জীবিকা: বর্তমানে অনেক চাকমা পরিবারই ফল চাষ (আনারস, কলা, আম), সমতল ভূমিতে ধান চাষ, মাছ ধরা, পশুপালন, সরকারি-বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হচ্ছে। নারীরা হাতে কাপড় বুনে বা তাঁতের কাজ করে পরিবারের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উপসংহার
চাকমা এথনিক গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সমাজ কাঠামো এবং উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন হাজার বছরের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ। যদিও নগরায়ণ এবং আধুনিক জীবনধারার প্রভাবে তাদের প্রথাগত জীবনে পরিবর্তন আসছে, তবুও চাকমারা তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে চলেছে। তাদের এই স্বতন্ত্র সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জাতীয় পরিচিতি ও বৈচিত্র্যের একটি অপরিহার্য অংশ।

