আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি আলোচনা কর
ভূমিকা
মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অতীতের তুলনায় বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য বহুলাংশে বিস্তৃত হয়েছে। শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই আজ আর রাষ্ট্রের কাজ সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে একটি রাষ্ট্রের আর্থিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বহু কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা
আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির অন্যতম প্রধান অংশ হলো সর্বজনীন ও মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তৃত করে।
২. স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ
জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রাষ্ট্র স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করে, হাসপাতাল নির্মাণ করে, ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং দরিদ্র জনগণের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে।
৩. কর্মসংস্থান সৃষ্টি
আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির মাধ্যমে সরকার বেকার সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকারী ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
বৃদ্ধ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা প্রদান, খাদ্য সহায়তা, এবং পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৫. দারিদ্র্য বিমোচন
দারিদ্র্য হ্রাসে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প যেমন- ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান, স্বনির্ভরতা উন্নয়ন ও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এসবই আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির আওতায় পড়ে।
৬. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ
রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আর্থিক পরিকল্পনা যেমন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন ইত্যাদি প্রণয়ন করা আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির মধ্যে পড়ে।
৭. অবকাঠামো উন্নয়ন
সড়ক, সেতু, রেলপথ, বিদ্যুৎ, পানীয়জল ও টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়ন আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
৮. শিল্পায়ন ও বাণিজ্য প্রসার
রাষ্ট্র দেশীয় শিল্পে সহায়তা দেয়, রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা প্রদান করে এবং বিভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে শিল্প ও বাণিজ্যকে শক্তিশালী করে। এসবই আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির আওতাভুক্ত।
৯. কৃষিখাত উন্নয়ন
কৃষি এখনও উন্নয়নশীল দেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত। কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
১০. পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন, বন সংরক্ষণ, দূষণ রোধসহ পরিবেশবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির অংশ।
১১. নারীর ক্ষমতায়ন
নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও নেতৃত্বে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
১২. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ দিক।
১৩. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, ডিজিটাল রূপান্তর নিশ্চিত করা ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটানো আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির অংশ।
১৪. যুব উন্নয়ন
যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সহায়তা ও নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করাও আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির মধ্যে পড়ে।
১৫. ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সংরক্ষণ
মানবাধিকার রক্ষা, আইনগত সহায়তা, ও বিচারিক প্রক্রিয়া সহজতর করাও আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ দিক।
উপসংহার
উপসংহারে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি আজকের বিশ্বে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্যে পড়ে। শুধু প্রতিরক্ষা বা শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্র তার জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, প্রযুক্তি, মানবাধিকার— সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপে আধুনিক রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি প্রতিফলিত হয়। ভবিষ্যতে এসব কার্যাবলিকে আরও মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব।