রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা দাও। এর ফলাফল কী হয়েছিল?

ভূমিকা

রবাট ক্লাইভ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, যিনি ভারতের উপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৭৬৫ সালে তিনি বাংলায় “দ্বৈত শাসন” (Dual System of Government) চালু করেন, যা এক নতুন ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল। এটি বাংলার নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতার এক অভিনব ভাগাভাগির পদ্ধতি। এখানে “রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা দাও। এর ফলাফল” এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ২য় পত্র এর উত্তর

Degree suggestion Facebook group


রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা

রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থাটি মূলত ১৭৬৫ সালে আল্লাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোম্পানি পায়, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে নবাবের অধীনস্ত থাকে। এই শাসন ব্যবস্থাটি ব্রিটিশদের জন্য লাভজনক হলেও সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিচে “রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা দাও। এর ফলাফল” বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—

১. দ্বৈতশাসনের সংজ্ঞা

দ্বৈতশাসন এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেখানে দুই পক্ষ শাসনের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। এখানে বাংলার নবাব নামমাত্র শাসক থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।

২. আল্লাহাবাদ চুক্তি (১৭৬৫)

পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪) এর পর নবাব মীর কাসিম পরাজিত হন। এরপর ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহ আলম এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে আল্লাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে।

৩. দেওয়ানি ও নিজামত ক্ষমতা

দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কোম্পানি পায়, আর নিজামত বা বিচারব্যবস্থা নবাবের হাতে থাকে। তবে বাস্তবে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা পরিচালনা করত।

৪. রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি রাজস্ব আদায় করত, যা স্থানীয় জমিদারদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ফলে কৃষক ও সাধারণ জনগণ অত্যাচারের শিকার হন।

৫. নবাবের ক্ষমতা হ্রাস

নবাব শুধু নামমাত্র শাসক ছিলেন। তার সেনাবাহিনী এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল।

৬. প্রশাসনিক দুর্বলতা

যেহেতু নবাবের প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে চুরি, ডাকাতি ও অবিচারের হার বেড়ে যায়।

৭. দুর্নীতি বৃদ্ধি

রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের ফলে কোম্পানির কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। তারা ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করতে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ায়।

৮. ব্যবসায়িক সুবিধা ব্রিটিশদের হাতে

বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।

৯. কৃষকদের দুরবস্থা

উচ্চ কর, দুর্নীতি এবং কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণের ফলে কৃষকরা দারিদ্র্যের শিকার হন।

১০. ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ

দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ১৭৭০ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, যেখানে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। কোম্পানি রাজস্ব আদায় বন্ধ করেনি, ফলে দুর্ভিক্ষ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।


রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের ফলাফল

রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল মারাত্মক। এটি বাংলার অর্থনীতি, প্রশাসন এবং সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংসের মুখে ফেলে। নিচে “রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা দাও। এর ফলাফল” বিষয়ের ফলাফল সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—

১. নবাবি শাসনের অবসান

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর হয়ে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। এর ফলে নবাবদের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়।

২. ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত হয়

এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসনের ভিত্তি আরও শক্তিশালী করে এবং ভবিষ্যতে সরাসরি শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যায়।

৩. স্থানীয় ব্যবসার পতন

বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এবং অন্যান্য ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশরা স্থানীয় ব্যবসার বিকাশ রোধ করে তাদের নিজস্ব শিল্পকে সমৃদ্ধ করে।

৪. শোষণের নতুন অধ্যায় শুরু

দ্বৈতশাসন কোম্পানির জন্য অত্যন্ত লাভজনক ছিল, কিন্তু সাধারণ জনগণের জন্য এটি ছিল এক শোষণমূলক ব্যবস্থা। এটি ব্রিটিশ শাসনের আরও নিষ্ঠুর নীতিগুলোর ভিত্তি তৈরি করে।

৫. ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ

দ্বৈতশাসনের ফলে ব্রিটিশদের শোষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বাড়তে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করে।


উপসংহার

রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসন বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য লাভজনক হলেও সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে। “রবাট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনের বর্ণনা দাও। এর ফলাফল” বিষয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, এটি বাংলার নবাবদের ক্ষমতা কমিয়ে ব্রিটিশদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। অবশেষে, ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন এবং সরাসরি শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তবে এই শাসন বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্টের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

Leave a Comment