সামাজিকীকরণ কী? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর।
সামাজিকীকরণ কী? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর। সামাজিকীকরণ…
সামাজিকীকরণ কী? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর।
সামাজিকীকরণ (Socialization) হলো এমন একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি মানবশিশু সমাজের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আদর্শ, বিশ্বাস এবং আচরণ পদ্ধতি শিখে একটি সক্রিয় ও সক্ষম সদস্য হিসেবে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এটি হলো ব্যক্তির সামাজিক অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল ভিত্তি। সামাজিকীকরণ ছাড়া কোনো মানুষই সমাজে টিকে থাকতে পারে না বা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি হলো ব্যক্তির জৈবিক সত্তাকে সামাজিক সত্তায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া।
সামাজিকীকরণ কী?
সামাজিকীকরণকে সমাজবিজ্ঞানী চার্লস হর্টন কুলি “স্ব-এর বিকাশ” (The Development of Self) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি মূলত দুটি মৌলিক কাজ করে:
১. ব্যক্তিগত বিকাশ: এটি ব্যক্তিকে ভাষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিক ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে, যা তাকে সমাজে সফলভাবে মিথস্ক্রিয়া করতে এবং ব্যক্তিত্ব গঠন করতে সাহায্য করে। ২. সামাজিক ধারাবাহিকতা: এর মাধ্যমে সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নিয়মাবলী এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়, ফলে সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
এই প্রক্রিয়াটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- প্রাথমিক সামাজিকীকরণ (Primary Socialization): শৈশবে পরিবারে শুরু হয় এবং ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে তোলে।
- মাধ্যমিক সামাজিকীকরণ (Secondary Socialization): শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল বা গণমাধ্যম থেকে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে সামাজিকীকরণ।
- পুনঃসামাজিকীকরণ (Resocialization): নতুন বা ভিন্ন পরিবেশে (যেমন: জেলখানা, নতুন দেশ বা নতুন পেশা) ব্যক্তির পুরাতন রীতিনীতি ত্যাগ করে নতুন রীতিনীতি শেখার প্রক্রিয়া।
সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা
সামাজিকীকরণের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো পরিবার (Family)। পরিবারকে সামাজিকীকরণের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়, কারণ একজন শিশু জীবনের প্রথম এবং মৌলিক শিক্ষা পরিবার থেকেই গ্রহণ করে। শিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি পরিবারেই স্থাপিত হয়।
১. ভাষা ও যোগাযোগের শিক্ষা:
শিশুরা পরিবার থেকেই ভাষা ও যোগাযোগের প্রাথমিক কৌশল শেখে। তারা তাদের পিতামাতা ও অন্যান্য সদস্যদের কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও ভাবভঙ্গির অনুকরণ করে, যা তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার প্রথম ধাপ।
২. মৌলিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা:
পরিবার শিশুদের সমাজের মৌলিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও রীতিনীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। যেমন— বড়দের সম্মান করা, সত্য কথা বলা, সহযোগিতা করা, জিনিস ভাগ করে নেওয়া, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ— এসবের শুরু পরিবারেই হয়। এগুলি শিশুর সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি করে।
৩. স্নেহ ও মানসিক নিরাপত্তা:
পরিবার শিশুদের স্নেহ, নিরাপত্তা ও আবেগিক সমর্থন প্রদান করে। এটি শিশুকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমাজের সম্মুখীন হতে এবং অন্যদের সাথে মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করে। পরিবারের ভালোবাসা ও যত্ন শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
৪. লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা শিক্ষা:
পরিবারের মাধ্যমে শিশুরা লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা (Gender Roles) সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পায়। যদিও আধুনিক সমাজে এই ধারণা পরিবর্তন হচ্ছে, তবুও ছেলে ও মেয়ের জন্য আলাদা খেলনা বা কাজের মাধ্যমে শিশুরা সমাজের প্রত্যাশিত লিঙ্গভিত্তিক আচরণ সম্পর্কে জানতে পারে।
৫. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ:
পরিবার শিশুর কাছে তার জাতিগত সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও প্রথাগুলো তুলে ধরে। পারিবারিক উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মাধ্যমে শিশু তার ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তা লালন করতে শেখে।
সামাজিকীকরণে ধর্মের ভূমিকা
ধর্ম (Religion) সামাজিকীকরণের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, বিশেষ করে একটি ঐতিহ্যবাহী বা রক্ষণশীল সমাজে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বাস ব্যক্তির নৈতিকতা, আচরণ ও বিশ্বদর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
১. নৈতিক ও মূল্যবোধের ভিত্তি:
ধর্ম মানুষের জন্য নৈতিকতার একটি কাঠামো তৈরি করে। প্রতিটি ধর্মই ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ এবং পাপ-পুণ্যের ধারণা দেয়। এই ধারণাগুলোই ব্যক্তিকে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সমাজের প্রত্যাশিত নৈতিক মান বজায় রাখতে উৎসাহিত করে।
২. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা:
ধর্মীয় অনুশাসনগুলো প্রায়শই ব্যক্তির আচরণকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলিত করে। ধর্মীয় ভয় বা পরকালীন পুরস্কারের ধারণা সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে মানুষকে উৎসাহিত করে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
৩. সংহতি ও ঐক্যবোধ সৃষ্টি:
ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবগুলো বিভিন্ন পটভূমির মানুষকে একত্রিত করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতিবোধ সৃষ্টি করে। এর ফলে একই ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর সামাজিক গোষ্ঠী বা কমিউনিটি গড়ে ওঠে। যেমন— ঈদ, পূজা বা বড়দিনের উৎসবগুলি মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করে।
৪. সামাজিক ভূমিকা শিক্ষা:
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন— মসজিদ, মন্দির, চার্চ, মাদ্রাসা) ব্যক্তিকে ধর্মীয় নেতা বা ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে সমাজে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা কী হবে, তা শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে বিনয়, পরোপকার ও সহনশীলতার মতো গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করে।
৫. জীবনদর্শনের কাঠামো:
ধর্ম মানুষকে জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি মানুষকে জন্ম, মৃত্যু, সৃষ্টি এবং জগতের কারণ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তাদের অনিশ্চয়তার মাঝে মানসিক শান্তি ও স্থিরতা প্রদান করে। এই জীবনদর্শন ব্যক্তির আচরণ ও সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে।
উপসংহার
সামাজিকীকরণ একটি চলমান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি একটি সক্রিয় সামাজিক প্রাণী হিসেবে গড়ে ওঠে। পরিবার শিশুর ব্যক্তিত্বের বীজ বপন করে তাকে আবেগিক সুরক্ষা ও মৌলিক সামাজিক রীতিনীতি শেখায়, অন্যদিকে ধর্ম তার নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করে এবং তাকে বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর সাথে যুক্ত করে। পরিবার এবং ধর্মের মতো শক্তিশালী এই প্রতিষ্ঠানগুলোই একজন মানুষকে সমাজের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, যা শেষ পর্যন্ত সমাজের স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।

