সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের বিবরণ দাও
ভূমিকা
সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট, যিনি ১৬০৫ সাল থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত ভারত শাসন করেন। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের পুত্র এবং মুঘল সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগের সূচনা করেন। তার শাসনামলে শিল্প, সংস্কৃতি, আইন ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে। এই প্রবন্ধে আমরা সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের বিবরণ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব।
১. সম্রাট জাহাঙ্গীরের সিংহাসনে আরোহণ
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালে নুরউদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি শক্তিশালী প্রশাসনের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল করেন।
২. ন্যায়বিচারের প্রতীক “স্বর্ণ শৃঙ্খল”
সম্রাট জাহাঙ্গীর তার রাজদরবারের বাইরে একটি স্বর্ণ শৃঙ্খল ঝুলিয়ে রাখেন, যাতে জনগণ সরাসরি তাদের অভিযোগ জানাতে পারে। এটি ন্যায় ও স্বচ্ছ প্রশাসনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩. নীতিনৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব
সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
৪. বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন
সম্রাট জাহাঙ্গীর বিচার বিভাগকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করে তোলেন। তিনি অনেক সময় নিজেই বিচারকার্য পরিচালনা করতেন এবং সাধারণ মানুষের বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতেন।
৫. ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সহাবস্থান
যদিও সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন মুসলিম শাসক, তিনি হিন্দু, খ্রিষ্টান, জৈন ও শিখদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। তবে শিখ গুরু অর্জুন দেবের সঙ্গে দ্বন্দ্বও তার শাসনামলে সংঘটিত হয়।
৬. সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রভাব
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান ছিলেন তার রাজত্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী নারী। তিনি রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন এবং একপ্রকার সম্রাজ্ঞীর ভূমিকা পালন করতেন।
৭. চিত্রকলা ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা
সম্রাট জাহাঙ্গীর চিত্রশিল্প ও শিল্পকলার প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। তার শাসনামলে মুঘল মিনিয়েচার চিত্রকলা বিশেষ উৎকর্ষতা অর্জন করে।
৮. পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেম
সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। তার লেখা আত্মজীবনী “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি”তে বিভিন্ন গাছ, ফুল, পশু-পাখির বর্ণনা পাওয়া যায়।
৯. রাজস্ব ব্যবস্থা
সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজস্ব ব্যবস্থাকে আগের ভিত্তির উপর গড়ে তুললেও কিছু নতুন পরিবর্তন এনেছিলেন। তার আমলে স্থানীয় জমিদারদের ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনেন।
১০. সীমান্ত অঞ্চল ও প্রতিরক্ষা
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকা যেমন: কাশ্মীর, আহমদনগর ও দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে সংঘাত ঘটে। তিনি দক্ষ সেনাপতি পাঠিয়ে এসব অঞ্চল পুনর্গঠন করেন।
১১. ইউরোপীয়দের আগমন
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেই ইংরেজরা ভারতে বাণিজ্য স্থাপন শুরু করে। ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো মুঘল দরবারে এসে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার অনুমতি পায়।
১২. বিদ্রোহ দমন
তার পুত্র খুররম (পরবর্তীকালে শাহজাহান) এবং মহারানা প্রতাপের উত্তরসূরিদের বিদ্রোহ দমন করতে সম্রাট জাহাঙ্গীর কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।
১৩. সাহিত্যচর্চা ও আত্মজীবনী
সম্রাট জাহাঙ্গীর তার নিজস্ব আত্মজীবনী “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি” রচনার মাধ্যমে ইতিহাসে অমূল্য তথ্য দিয়ে গেছেন। এতে রাজ্য পরিচালনা, বিচার, প্রকৃতি ও জীবনদর্শনের আলোচনা রয়েছে।
১৪. সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুবরণ
১৬২৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীর থেকে লাহোর ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লাহোরে সমাহিত করা হয় এবং তার সমাধি আজও ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান।
১৫. সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বের প্রভাব
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও প্রশাসনিক সুশাসনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। তার পরবর্তী সম্রাট শাহজাহান এই ভিত্তির উপর সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তার করেন।
উপসংহার
সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন এক দক্ষ, ন্যায়পরায়ণ ও সংস্কৃতিপ্রেমী শাসক। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য সংস্কৃতি, শিল্প, প্রশাসন ও নীতিনৈতিকতায় উৎকর্ষ লাভ করে। “সম্রাট জাহাঙ্গীর” ইতিহাসে এমন এক নাম যা একাধারে ন্যায়ের প্রতীক, শিল্পকলার অনুরাগী ও শক্তিশালী প্রশাসকের নিদর্শন।
📚 নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স:
https://www.britannica.com/biography/Jahangir-Mughal-emperor