শিল্প জাতীয়করণ কি? বাংলাদেশের শিল্প জাতীয়করণের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর

শিল্প জাতীয়করণ কি? বাংলাদেশের শিল্প জাতীয়করণের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর

ভূমিকা

শিল্প জাতীয়করণ একটি অর্থনৈতিক নীতি যার মাধ্যমে কোনো দেশের সরকার বেসরকারি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রূপান্তর করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিল্প জাতীয়করণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব শিল্প জাতীয়করণ কী, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।


শিল্প জাতীয়করণ কী?

শিল্প জাতীয়করণ বলতে বোঝায়, যখন সরকার দেশের বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসমূহকে বেসরকারি মালিকানার বদলে সরকারি মালিকানায় নিয়ে আসে। এ ধরনের উদ্যোগ সাধারণত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সম্পদের সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং জনস্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে শিল্প জাতীয়করণের শুরু হয় স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালে। সে সময় দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল পাকিস্তানি মালিকানাধীন। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এসব শিল্পের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে শিল্প জাতীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু করে।


শিল্প জাতীয়করণের উদ্দেশ্য

১. দেশীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে নেওয়া
২. মৌলিক ও ভারী শিল্পের বিকাশ
৩. কর্মসংস্থান সৃষ্টি
৪. জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন
৫. আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস
৬. দেশের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি
৭. সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা


শিল্প জাতীয়করণের সুবিধাসমূহ

১. অর্থনীতির উপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ

শিল্প জাতীয়করণ সরকারের হাতে শিল্প ও উৎপাদন ব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। ফলে সরকার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টনে সক্ষম হয়।

২. প্রাথমিক পর্যায়ে অব্যবস্থাপনার প্রতিকার

স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি মালিকরা দেশ ত্যাগ করে গেলে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। শিল্প জাতীয়করণ এই অচল অবস্থাকে উত্তরণে সহায়তা করে।

৩. জাতীয় সম্পদের নিরাপত্তা

শিল্প জাতীয়করণ জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়ক হয়।

৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বৃহৎ আকারে পরিচালিত হয় এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ঘটে।

৫. আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা

শিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারের পক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারসাম্যপূর্ণ শিল্প স্থাপন করা সহজ হয়, যা আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে সহায়ক।

৬. জনসেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি

বেসরকারি উদ্যোক্তারা অধিক মুনাফা লক্ষ্য করে কাজ করলেও রাষ্ট্র মালিকানাধীন শিল্পগুলো জনসেবামূলক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, যেমন- খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানী প্রভৃতি।

৭. দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা

শিল্প জাতীয়করণের ফলে দেশীয় শিল্পগুলো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা পায় এবং তাদের বিকাশে রাষ্ট্র সহায়তা প্রদান করে।

৮. কর রাজস্ব বৃদ্ধি

রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কর ও লভ্যাংশের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়।


শিল্প জাতীয়করণের অসুবিধাসমূহ

৯. অদক্ষ ব্যবস্থাপনা

সরকারি খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব থাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়।

১০. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ

শিল্প জাতীয়করণের ফলে সরকার রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দিয়ে শিল্প পরিচালনা করে, যার ফলে পেশাদারিত্বের ঘাটতি দেখা যায়।

১১. লাভজনকতা হ্রাস

বেসরকারি খাত যেখানে মুনাফা অর্জনে উদ্দীপ্ত, সেখানে রাষ্ট্রীয় খাতে সেই উদ্দীপনা ও উদ্যোগের অভাব থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়ে।

১২. দুর্নীতি ও অনিয়ম

শিল্প জাতীয়করণের পর অনেক রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও অনিয়ম শুরু হয়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

১৩. উদ্ভাবন ও গবেষণার ঘাটতি

সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বরাদ্দ কম থাকে, যা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

১৪. প্রতিযোগিতার অভাব

শিল্প জাতীয়করণ প্রতিযোগিতা হ্রাস করে, ফলে মান উন্নয়ন ও সেবার মান রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে।

১৫. রাষ্ট্রীয় বোঝা বৃদ্ধি

অকার্যকর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়ে রাখতে সরকারকে বারবার ভর্তুকি দিতে হয়, যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।


বাংলাদেশের শিল্প জাতীয়করণের ইতিহাস ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে শিল্প জাতীয়করণের সূচনা হয় ১৯৭২ সালের “Industrial Enterprises (Nationalisation) Order” এর মাধ্যমে। প্রায় ৩০০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। সেই সময় সরকারের ধারণা ছিল, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব।

তবে সময়ের সাথে সাথে দেখা যায় যে, এই শিল্প জাতীয়করণ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ। ১৯৮০-এর দশকে Structural Adjustment Program (SAP) এর আওতায় বিশ্বব্যাংক ও IMF-এর পরামর্শে বাংলাদেশ বেসরকারিকরণ নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

তবে এখনও বাংলাদেশে অনেক রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে বিসিক, বেসিক ব্যাংক, বিসিএসআইআর, বিটিএমসি, বিসিএল, বিএসএফআইসি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্প জাতীয়করণ

বর্তমান বিশ্বে শিল্প জাতীয়করণ একটি বিতর্কিত অর্থনৈতিক কৌশল। অনেক উন্নয়নশীল দেশ এখন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় আগ্রহী। বাংলাদেশেও একই ধারা অনুসরণ করা হচ্ছে, যেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত (যেমন: বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্য) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অন্যান্য খাতগুলো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত।


ভবিষ্যৎ করণীয়

বাংলাদেশে শিল্প জাতীয়করণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া সঠিক নয়, বরং যেসব খাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য (যেমন—জ্বালানি, প্রতিরক্ষা, রেলপথ, পানীয় জল সরবরাহ) সেখানে এটি চালু রাখা যেতে পারে। তবে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন:

  • দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা
  • রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ
  • পেশাদার নিয়োগ ও স্বচ্ছতা
  • আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ
  • লোকসানি প্রতিষ্ঠান সংস্কার বা বেসরকারিকরণ

উপসংহার

শিল্প জাতীয়করণ একটি যুগোপযোগী নীতিমালা হিসেবে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত স্থাপন, সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে শিল্প জাতীয়করণের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি যেমন উন্নয়নের হাতিয়ার হতে পারে, তেমনি ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে তা দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যালান্সড নীতি দরকার, যেখানে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং অন্যান্য খাতগুলোতে বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাবে। এর মাধ্যমে একটি টেকসই, উদ্ভাবনী ও গতিশীল শিল্পখাত গড়ে তোলা সম্ভব।

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment