রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক কে, তা নিয়ে দুটি ভিন্ন মত প্রচলিত আছে:
- এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথম আলোচনা করেন এবং তাঁর “পলিটিক্স” গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। এ কারণে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের “আদি গুরু” বা “জনক” হিসেবে গণ্য করা হয়।
- অন্যদিকে, নিকোলো মেকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাঁর “দ্য প্রিন্স” গ্রন্থটি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি স্থাপন করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতিসমূহ
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা গবেষকদের রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: সনাতন (Traditional) পদ্ধতি এবং আধুনিক (Modern) পদ্ধতি।
সনাতন পদ্ধতিসমূহ
সনাতন পদ্ধতিগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরোনো বা ক্লাসিক্যাল অধ্যয়ন পদ্ধতি। এগুলো প্রধানত নৈতিকতা, ইতিহাস, আইন এবং দর্শনকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
- ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Method): এই পদ্ধতিতে অতীতের রাজনৈতিক ঘটনা, প্রতিষ্ঠান এবং চিন্তাভাবনা বিশ্লেষণ করে বর্তমানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের “তৃতীয় মাত্রা” বলা হয়, কারণ এটি ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভিত্তিহীন।
- দার্শনিক পদ্ধতি (Philosophical Method): এই পদ্ধতিতে আদর্শ রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, ক্ষমতা ইত্যাদি মৌলিক ধারণাগুলোর দার্শনিক ভিত্তি এবং নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্লেটো, এরিস্টটল, রুশো, লক প্রমুখ দার্শনিকের লেখায় এর দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
- আইনগত পদ্ধতি (Legal Method): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র ও সরকারের আইনগত দিক, সংবিধান, আইন এবং বিচার ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক কাঠামো এবং আইনি প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণা অর্জন করা হয়।
- প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি (Institutional Method): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন – আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ইত্যাদির গঠন, কার্যাবলী এবং ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আধুনিক পদ্ধতিসমূহ
আধুনিক পদ্ধতিগুলো বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এগুলোতে বিজ্ঞানসম্মত ও গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
- আচরণগত পদ্ধতি (Behavioral Method): এই পদ্ধতিতে মানুষের রাজনৈতিক আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করা হয়। ভোটদান আচরণ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব, জনমত ইত্যাদি বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করা হয়। এটি বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে রাজনৈতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করতে চায়।
- অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি (Empirical Method): এই পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ, জরিপ, পরিসংখ্যান এবং কেস স্টাডির মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। এর লক্ষ্য হলো বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক তত্ত্ব তৈরি করা।
- ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (System Approach): এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে একটি জটিল ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ইনপুট (চাহিদা, সমর্থন), আউটপুট (নীতি, সিদ্ধান্ত), এবং প্রতিক্রিয়া (feedback) প্রক্রিয়াগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত। এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যেকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
- তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative Method): এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান, নীতি বা আচরণ তুলনা করে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য খুঁজে বের করা হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণীকরণ করা সম্ভব হয়।
- মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি (Psychological Method): এই পদ্ধতিতে মানুষের মনস্তত্ত্ব, আবেগ, অনুপ্রেরণা এবং বিশ্বাস কিভাবে রাজনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করে তা বিশ্লেষণ করা হয়। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনমতের উপর মনোবিজ্ঞানীর প্রভাব আলোচনা করে।
- অর্থনৈতিক পদ্ধতি (Economic Method): এই পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক কারণসমূহ কিভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে তা পরীক্ষা করা হয়। এটি রাজনীতিতে অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সম্পদের বিতরণের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য এই সকল পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবহার একটি পূর্ণাঙ্গ এবং গভীরতর বিশ্লেষণ প্রদান করে।