১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর ভারতীয় উপমহাদেশের…
১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
ভারতীয় উপমহাদেশের উপনিবেশিক ইতিহাসে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই আইনটি ১৯০৯ সালে Indian Councils Act হিসেবে ব্রিটিশ সরকার দ্বারা প্রণীত হয় এবং এটি তৎকালীন ভারতের শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যদিও এই আইন প্রশাসনিক সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে প্রস্তাবিত ছিল, তবুও এটি রাজনৈতিক কৌশল, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও জাতীয়তাবাদ দমনের একটি সরঞ্জামে পরিণত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা ১৫টি দৃষ্টিকোণ থেকে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন-এর বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করব।
১. আইন পরিষদে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি
মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন অনুসারে সেন্ট্রাল এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬০ করা হয়। প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলোতেও অনুরূপভাবে সদস্য বাড়ানো হয়, যা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা ছিল।
২. ভারতীয়দের নির্বাচন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি
এই আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতীয়দের নির্বাচনের মাধ্যমে আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। যদিও অধিকাংশ সদস্য মনোনীত হতো, তবুও এটি ছিল প্রথমবারের মতো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভারতীয় অংশগ্রহণের সূচনা।
৩. মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা
মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন-এর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা (Separate Electorate) প্রবর্তন। এর ফলে মুসলমানরা শুধুমাত্র মুসলমান প্রার্থীদের ভোট দিতে পারত। এই ব্যবস্থা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তি গড়ে দেয়।
৪. আইন পরিষদে প্রশ্ন করার অধিকার
এই আইন ভারতীয় সদস্যদের বাজেটের ওপর প্রশ্ন তোলার এবং আলোচনা করার সীমিত অধিকার দেয়। যদিও এই ক্ষমতা ছিল নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ, তবুও এটি একটি নতুন দিকচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ
মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন অনুসারে, ভারতীয় সদস্যরা প্রথমবারের মতো সরকারি নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ পায়। যদিও সেসব প্রস্তাব কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল, তবুও এটি রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সীমিত স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
৬. প্রশাসনিক ও নির্বাহী ক্ষমতায় কোনো বড় পরিবর্তন নয়
আইনটি ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দিলেও প্রকৃত শাসনক্ষমতা ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হাতেই ছিল। ভাইসরয় ও গভর্নররা যেকোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারতেন। মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন তাই মূলত ছিল একটি প্রতীকী সংস্কার।
৭. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা
মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঢুকে পড়ে। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা ভারত বিভাজনের বীজ রোপণ করে।
৮. মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহ
১৯০৬ সালে গঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখে। মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়।
৯. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের আশ্বস্ত করার প্রয়াস
এই সংস্কারের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রশাসনের অংশীদার করার প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন মূলত ছিল একটি রাজনৈতিক শান্তি কৌশল।
১০. জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের আইনি ভিত্তি
এ আইন ছিল উপনিবেশিক শাসনের Divide and Rule নীতির বাস্তব রূপ। হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকে আইনত স্বীকৃতি দিয়ে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয় সমাজে পারস্পরিক অবিশ্বাসকে স্থায়ী করে তোলে।
১১. ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতীকী উদারতা
এই আইনটি ব্রিটিশ প্রশাসনের উদারতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হলেও বাস্তবত ছিল শাসনব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রাখার এক রাজনৈতিক আয়োজন। ভারতীয়দের “অংশগ্রহণ” ছিল নামমাত্র, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশদেরই হাতে।
১২. জাতীয়তাবাদীদের বিভ্রান্ত করার কৌশল
মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন দ্বারা কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সংগঠনকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের দাবিকে বিবেচনা করছে। ফলে অনেক নেতাই বিভ্রান্ত হন এবং আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৩. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
এ আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়ের এক নতুন চেতনা সৃষ্টি করে। পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে, তারা একটি “স্বতন্ত্র জাতি”। এই মনোভাব ভবিষ্যতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৪. ভারতীয় রাজনীতিতে বিভাজন ও দ্বিধা
এই সংস্কারের ফলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ব্রাহ্মসমাজ, আর্যসমাজসহ বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ বাড়ে। মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয় রাজনীতিকে একত্র না করে আরও খণ্ডিত করে তোলে।
১৫. ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ভিত্তি
যদিও আইনটি ছিল সীমাবদ্ধ, তবুও এটি ভবিষ্যতের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯) ও পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এর ভিত্তি রচনা করে। মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন এভাবে ভারতের সাংবিধানিক উন্নয়নে একটি প্রাথমিক ধাপ হয়ে ওঠে।
উপসংহার
মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ছিল একটি জটিল রাজনৈতিক কৌশল। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামান্য রাজনৈতিক অধিকার দিয়ে বড় মাপের রাজনৈতিক লাভ অর্জনের চেষ্টা করেছিল। এই আইন ভারতীয়দের মধ্যে সামান্য অংশগ্রহণের সুযোগ দিলেও তার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, জাতীয় ঐক্যের দুর্বলতা, এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আইনটি ভারতীয় রাজনীতিকে গণতন্ত্রের পথে না নিয়ে বরং বিভক্তির পথে ঠেলে দেয়।
অবশেষে বলা যায়, মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ইতিহাসে যেমন রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতীক, তেমনি বিভক্ত ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম সূচনা বিন্দুও বটে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভারতবর্ষের বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
Degree suggestion Facebook group
২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর