বাংলাদেশে সামাজিক অসমতার কারণগুলো বিশ্লেষণ কর।
বাংলাদেশে সামাজিক অসমতার কারণগুলো বিশ্লেষণ কর। সামাজিক অসমতা (Social Inequality)…
বাংলাদেশে সামাজিক অসমতার কারণগুলো বিশ্লেষণ কর।
সামাজিক অসমতা (Social Inequality) বলতে বোঝায় সমাজে সম্পদ, সুযোগ, ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিধাগুলোর অসম বন্টন। বাংলাদেশে সামাজিক অসমতা একটি গভীর ও বহুমাত্রিক সমস্যা, যা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর বিস্তৃতি রয়েছে। এই অসমতা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পথে প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর প্রধান কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. অর্থনৈতিক কারণসমূহ
সামাজিক অসমতা সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সম্পদের কেন্দ্রীভবন।
- সম্পদের অসম বন্টন ও ভূমিস্বত্ব: বাংলাদেশে সম্পদের অসম বন্টন চরম পর্যায়ে রয়েছে। কৃষি জমির মালিকানা হাতেগোনা কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় গ্রামীণ সমাজে ভূমিহীনতা ও দরিদ্রতা বেড়েছে। শিল্প ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও পুঁজি কয়েকজন সুবিধাভোগীর হাতে চলে গেছে, যা আয় বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে।
- আয় ও ভোগ বৈষম্য: উচ্চ-আয়ের মানুষের সাথে নিম্ন-আয়ের মানুষের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের আয় সাধারণ শ্রমিক বা কৃষকের আয়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এই আয় বৈষম্য ভোগের ক্ষেত্রেও অসমতা তৈরি করে (যেমন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় পার্থক্য)।
- সুযোগের অভাব: দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যাপ্ত ঋণ, প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায় না। ফলে তারা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে না এবং গরিব-ধনী ব্যবধান বজায় থাকে।
- দুর্নীতি ও কালো টাকা: ব্যাপক দুর্নীতি এবং কালো টাকার অর্থনীতি সমাজের সম্পদকে কিছু সংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করেছে। এর ফলে সমাজে নৈতিকতার অবনতি ঘটে এবং সুযোগ-সুবিধার বন্টন মেধা বা যোগ্যতার বদলে ক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
২. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণসমূহ
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা সামাজিক অসমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
- ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন: রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় elite শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় নীতি এবং সম্পদ বন্টনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। এর ফলে সাধারণ মানুষেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।
- দুর্বল শাসন (Poor Governance): কার্যকর ও স্বচ্ছ শাসনের অভাবে এবং আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণ বা শোষণ বন্ধ করা সম্ভব হয় না। দুর্বল মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার অভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দরিদ্রদের কাছে পৌঁছায় না।
- স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব: রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বদলে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে চাকরি, ঠিকাদারি বা অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়। এটি সমাজে আরও একটি অসাম্য তৈরি করে।
৩. শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক কারণসমূহ
শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিও সামাজিক অসমতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- শিক্ষার বৈষম্য: বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট। মানসম্মত শিক্ষা ধনী বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য অনেকটাই সংরক্ষিত। অপরদিকে, দুর্বল সরকারি স্কুল বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নিম্নমানের শিক্ষা গ্রহণ করে, যা তাদের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সুযোগগুলোকে সীমিত করে দেয়। অর্থাৎ, শিক্ষা নিজেই সামাজিক অসমতার উত্তরাধিকার বহন করে।
- স্বাস্থ্যসেবায় অসমতা: স্বাস্থ্যসেবার মান ও সুযোগ গ্রাম ও শহরের মধ্যে, এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে চরমভাবে বিভক্ত। নিম্ন আয়ের মানুষেরা মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না, ফলে রোগ ও শারীরিক দুর্বলতা তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আরও কমিয়ে দেয়।
- পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো: বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো নারীদের জন্য অসমতা সৃষ্টি করে। সম্পত্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। কর্মক্ষেত্রে কম মজুরি, যৌন হয়রানি এবং সীমিত গতিশীলতা নারীকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখে।
৪. ভৌগোলিক ও গ্রামীণ-শহুরে বৈষম্য
ভৌগোলিক অবস্থান এবং গ্রামীণ-শহুরে বিভাজনও বৈষম্যের অন্যতম কারণ।
- গ্রামীণ-শহুরে বিভাজন: বাংলাদেশের অধিকাংশ সম্পদ, উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিল্প-বাণিজ্যের সুযোগ শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলের মানুষ এই সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত হয়, যা গ্রামীণ দারিদ্র্য ও অসমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
- আঞ্চলিক বৈষম্য: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়নের গতি সমান নয়। যেমন— ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো শহরগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্যান্য পিছিয়ে পড়া অঞ্চল (যেমন— উত্তরবঙ্গ বা উপকূলীয় অঞ্চল) থেকে অনেক বেশি। এই আঞ্চলিক বৈষম্য স্থানীয় সামাজিক অসমতা সৃষ্টি করে।
- দুর্বল যোগাযোগ ও অবকাঠামো: যোগাযোগ ও অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ে।
উপসংহার
বাংলাদেশে সামাজিক অসমতা হলো অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যের সম্মিলিত ফল। এই অসমতা কাটিয়ে উঠতে হলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন সুষম সম্পদ বন্টন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন, শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য হ্রাস এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট সামাজিক নীতি গ্রহণ করা। সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য এই বহুমুখী অসমতার কারণগুলো চিহ্নিত করে স্থায়ী সমাধান করা অত্যাবশ্যক।

