বাংলাদেশে বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায়সমূহ
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন, কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশ, উদ্যোক্তা তৈরি ও সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার, শ্রম বাজারের তথ্য সহজলভ্যকরণ, নীতি সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী ও ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় বাধা। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইলেও চাহিদার তুলনায় সীমিত সুযোগ তাদের হতাশ করে। এই বেকার সমস্যা শুধু ব্যক্তিগত আর্থিক সংকটের জন্ম দেয় না, বরং এটি সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ বৃদ্ধি এবং মানবসম্পদের অপচয়ের কারণ হয়। দেশের বিশাল তরুণ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে না পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। তাই, বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। এই নিবন্ধে, আমরা বাংলাদেশে বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
১. শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগীতা
বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায়শই বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর এবং তাত্ত্বিক শিক্ষা পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা বাস্তব কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনা জরুরি।
- পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, সাইবার নিরাপত্তা, এবং ব্লকচেইনের মতো বিষয়গুলো শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
- ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর: কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা এবং কেস স্টাডিভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বাড়িয়ে ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
- শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা অত্যাবশ্যক। তাদের শুধুমাত্র জ্ঞানের সরবরাহকারী না হয়ে শিক্ষার্থীদের মেন্টর হিসেবে কাজ করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
২. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার
দক্ষ জনশক্তির অভাব বেকার সমস্যার একটি অন্যতম কারণ। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটানো অত্যন্ত কার্যকর।
- প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি: দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আধুনিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এই কেন্দ্রগুলোতে ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং, ওয়েল্ডিং, অটোমোবাইল, আইটি সাপোর্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, পোশাক শিল্প, ইত্যাদি বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- মানসম্মত প্রশিক্ষণ: প্রশিক্ষণের মান নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রশিক্ষণার্থীরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দক্ষ হতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যৌথভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।
- প্রশিক্ষণ পরবর্তী কর্মসংস্থান: প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করতে হবে। নিয়োগকর্তাদের সাথে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন এবং জব ফেয়ার আয়োজন করা যেতে পারে।
৩. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (SME) উন্নয়ন
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে এই খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।
- সহজ ঋণ প্রাপ্তি: ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং সুদের হার কমাতে হবে। জামানতবিহীন ঋণের সুযোগ বাড়াতে হবে।
- প্রযুক্তিগত সহায়তা: এসএমই উদ্যোক্তাদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি ভর্তুকি বা সহজ শর্তে প্রযুক্তি সরবরাহ করা যেতে পারে।
- বাজার সংযোগ: এসএমই পণ্য ও সেবার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করতে হবে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৪. কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি এখনও কৃষি। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ এবং বহুমুখীকরণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
- প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, যেমন – যান্ত্রিকীকরণ, উন্নত বীজ, এবং সেচ ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে।
- উচ্চ মূল্যের ফসল চাষ: কেবল ধান নয়, বরং উচ্চ মূল্যের ফসল যেমন – ফল, সবজি, মাছ, পশুপালন, এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে।
- কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ: কৃষি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রামীণ এলাকায় ছোট শিল্প স্থাপন করে প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে।
৫. তথ্যপ্রযুক্তি (IT) খাতের বিকাশ
তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল একটি খাত এবং বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে এর সম্ভাবনা অপরিসীম।
- আইটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে আইটি সম্পর্কিত কোর্স ও প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরিতে জোর দিতে হবে।
- ডিজিটাল অবকাঠামো: দ্রুত গতির ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল অবকাঠামো সারাদেশে নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।
- স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: আইটি স্টার্টআপদের জন্য ইনকিউবেটর, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং মেন্টরশিপের সুযোগ বাড়াতে হবে।
৬. উদ্যোক্তা তৈরি ও সহায়তা
নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায়গুলির মধ্যে অন্যতম কার্যকর। উদ্যোক্তারা কেবল নিজের জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন।
- উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ: তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়ন, অর্থায়ন, ও বিপণনের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- সহজ অর্থায়ন: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- নীতি সহায়তা: উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরু করা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে (যেমন – ট্রেড লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন)।
৭. অবকাঠামো উন্নয়ন
দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
- যোগাযোগ ব্যবস্থা: সড়ক, সেতু, রেলওয়ে এবং বন্দরের উন্নয়ন নির্মাণ খাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিনিয়োগ এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে।
- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি শিল্পায়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহায্য করে।
- নগর উন্নয়ন: পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন, আবাসন প্রকল্প এবং আধুনিক শহরের অবকাঠামো নির্মাণ বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য কাজ তৈরি করে।
৮. বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও নিরাপদ অভিবাসন
বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কাজ করেন এবং রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখেন। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- নতুন শ্রমবাজার অন্বেষণ: প্রচলিত শ্রমবাজারের পাশাপাশি নতুন দেশগুলোতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের জন্য বাজার তৈরি করতে হবে।
- ভাষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ: বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের জন্য ভাষা জ্ঞান এবং প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- নিরাপদ অভিবাসন: মানব পাচার রোধ এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা বাড়াতে হবে।
৯. রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার ও বিনিয়োগে উৎসাহ
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। এই রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
- উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ: রেমিট্যান্সকে অনুৎপাদনশীল খাত (যেমন – জমি কেনা) থেকে উৎপাদনশীল খাতে (যেমন – ছোট শিল্প, কৃষি উদ্যোগ) বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
- বিনিয়োগ পরামর্শ: প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ এবং লাভজনক প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করতে হবে।
- শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ: দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য শেয়ার বাজারে রেমিট্যান্স বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
১০. শ্রম বাজারের তথ্য সহজলভ্যকরণ
সঠিক তথ্যের অভাবে অনেক সময় চাকরিপ্রার্থীরা তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের সন্ধান পায় না। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে শ্রম বাজারের তথ্য সহজলভ্য করা জরুরি।
- অনলাইন পোর্টাল: একটি কেন্দ্রীভূত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে নিয়োগকর্তারা তাদের শূন্য পদের বিজ্ঞাপন দিতে পারবে এবং চাকরিপ্রার্থীরা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সন্ধান করতে পারবে।
- ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং: স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং শ্রম বাজারের চাহিদা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে হবে।
- শ্রম বাজার জরিপ: নিয়মিত শ্রম বাজার জরিপ পরিচালনা করে কোন খাতে কি ধরনের দক্ষতার চাহিদা আছে, তা চিহ্নিত করতে হবে।
১১. নীতি সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি
সরকারের সঠিক নীতি এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ: দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে হবে এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
- কর প্রণোদনা: নতুন শিল্প স্থাপন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগকারীদের কর প্রণোদনা বা অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।
- সরকারি বিনিয়োগ: সরকারকেও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সরাসরি বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
১২. গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন
গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ বাস করে। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন অপরিহার্য।
- গ্রামভিত্তিক শিল্প: গ্রামে কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কুটির শিল্প এবং হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে।
- গ্রামীণ অবকাঠামো: গ্রামীণ রাস্তা, বাজার, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের উন্নতি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে হবে।
- ছোট ব্যবসার সহায়তা: গ্রামের ছোট ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা প্রদান করতে হবে।
১৩. নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা
নারীরা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হলে অর্থনীতিতে তাদের অবদান বৃদ্ধি পাবে।
- বিশেষ ঋণ সুবিধা: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে এবং কম সুদে বিশেষ ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
- প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ: নারীদের জন্য ব্যবসা পরিকল্পনা, পরিচালনা এবং বিপণনের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম আয়োজন করতে হবে।
- বাজার সংযোগ: নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার জন্য বাজার সংযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
১৪. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP)
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP) বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে এই মডেল কার্যকর।
- বড় প্রকল্প: সড়ক, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বন্দর এবং অন্যান্য বড় অবকাঠামো প্রকল্পে PPP মডেল ব্যবহার করে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়।
- দক্ষতা উন্নয়ন: দক্ষতা উন্নয়ন এবং কারিগরি প্রশিক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
- গবেষণা ও উদ্ভাবন: গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কাজে PPP মডেল ব্যবহার করে নতুন পণ্য ও সেবা তৈরি করা যেতে পারে।
১৫. গবেষণা ও উদ্ভাবন
একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবন অপরিহার্য। বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে এই খাতে বিনিয়োগ জরুরি।
- গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) বিনিয়োগ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
- নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ: আধুনিক ও উদীয়মান প্রযুক্তি গ্রহণ এবং স্থানীয়ভাবে এর প্রয়োগ ও বিকাশে উৎসাহিত করতে হবে।
- উদ্ভাবনী সংস্কৃতি: তরুণদের মধ্যে উদ্ভাবনী মানসিকতা তৈরি করতে এবং নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে উল্লিখিত পদক্ষেপের সমন্বিত ও কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এটি একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং এর সমাধানে শুধুমাত্র সরকারের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প খাত, বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তি পর্যায় থেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কারিগরি প্রশিক্ষণের প্রসার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশ, এবং উদ্যোক্তা তৈরির ওপর জোর দিলে বাংলাদেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু বেকার সমস্যাই সমাধান হবে না, বরং দেশ একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি কর্মময় ও সমৃদ্ধ জীবন উপহার দিতে বেকার সমস্যা দূরীকরণের উপায় নিয়ে এখনই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা অত্যন্ত জরুরি।