সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি পর্যালোচনা কর

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি পর্যালোচনা কর

ভূমিকা

ভারতের ইতিহাসে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) ছিলেন সবচেয়ে বিতর্কিত ও সর্বাধিক ক্ষমতাশালী সম্রাটদের একজন। তাঁর দীর্ঘ ৪৯ বছরের শাসনামলে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি নানা নীতি ও কৌশল গ্রহণ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি। এই নীতির লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং মারাঠা, বিজয়নগর উত্তরসূরি ও অন্যান্য স্বাধীন রাজ্য দমন। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি বিশ্লেষণ করব।


১. দাক্ষিণাত্য নীতির পটভূমি

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মূলত দক্ষিণ ভারতের স্বাধীন শক্তিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়। বিশেষ করে গোলকুন্ডা, বিজাপুর ও মারাঠা শক্তি ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।


২. মারাঠা সমস্যার উদ্ভব

শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠারা আওরঙ্গজেবের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। শিবাজীর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ও গেরিলা কৌশল আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। ফলে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মারাঠা দমনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।


৩. বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল

১৬৮৬-৮৭ সালে আওরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্য দখল করেন। এই পদক্ষেপ তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতির বাস্তব রূপায়ন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারের নিদর্শন।


৪. দক্ষিণে সরাসরি সামরিক অভিযান

সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে সরাসরি সেনা পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেন, যা ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ থেকে বোঝা যায় যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি কতটা অগ্রাধিকার পেয়েছিল।


৫. দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক ক্ষয়

দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততার ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজকোষে ব্যাপক চাপ পড়ে। একে বলা হয় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আর্থিক সূচনা।


৬. মারাঠাদের গেরিলা যুদ্ধ কৌশল

শিবাজী এবং তাঁর উত্তরসূরিরা গেরিলা কৌশলের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। আওরঙ্গজেব এই যুদ্ধকে একেবারে নির্মূল করতে না পারায় সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি অনেকাংশেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।


৭. ধর্মীয় রূপ

দাক্ষিণাত্য নীতিতে আওরঙ্গজেব ইসলামিক অনুশাসনকে প্রাধান্য দেন এবং অনেক হিন্দু রাজা ও মন্দিরের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। এই কারণে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।


৮. প্রশাসনিক দুর্বলতা

সম্রাট যখন দক্ষিণে ব্যস্ত ছিলেন, তখন উত্তর ভারতে প্রশাসনিক দুর্বলতা দেখা দেয়। শাসন ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, যা মুঘল প্রশাসনের সার্বিক পতনে ভূমিকা রাখে।


৯. মুঘল বাহিনীর ক্লান্তি

দীর্ঘদিনের যুদ্ধে মুঘল বাহিনী ক্লান্ত ও demoralized হয়ে পড়ে। ফলে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি দীর্ঘকাল টিকলেও কার্যকরতা হারায়।


১০. স্থানীয় রাজাদের বিদ্রোহ

দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের ছোট রাজ্য ও জমিদাররা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করে। আওরঙ্গজেব এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে আরও বেশি সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হন।


১১. মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান

শিবাজীর মৃত্যুর পর মারাঠা নেতৃত্ব পেশওয়া বালাজি বিশ্বনাথ ও বাজিরাও এর হাতে চলে যায় এবং তারা শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এতে স্পষ্ট যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মারাঠা শক্তিকে দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে।


১২. সামরিক খরচ ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা

দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে রাজকোষ নিঃশেষ হয়ে যায়। মহার্ঘ্য যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে আওরঙ্গজেবকে অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয়, যা প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।


১৩. রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব

আওরঙ্গজেব যেভাবে দাক্ষিণাত্যে রাজ্যগুলোকে বলপ্রয়োগে দমন করেন, তা কূটনৈতিকভাবে যথার্থ ছিল না। ফলে তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি শুধু সামরিক সাফল্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়।


১৪. মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন সূচনা

দাক্ষিণাত্য নীতি কার্যকর করতে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ ও সেনা খরচ হয়েছে, তা সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।


১৫. সামগ্রিক মূল্যায়ন

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি স্বল্পমেয়াদে সামরিকভাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য আত্মঘাতী ছিল। অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে এটি এক প্রকার ব্যর্থ কৌশলে পরিণত হয়।


উপসংহার

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ছিল তাঁর শাসনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ সামরিক প্রচেষ্টা। যদিও কিছু রাজ্য জয় তাঁর সামরিক সাফল্যের প্রতীক, তবুও এই নীতির কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। এই নীতি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, সামরিক দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে ইতিহাসে এক শিক্ষা হয়ে রয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, অতিরিক্ত সাম্রাজ্য বিস্তার কখনো কখনো পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


নির্ভরযোগ্য সূত্র:

Degree suggestion Facebook group

২য় বর্ষ ডিগ্রি পরিক্ষার সকল বিষয়ের সাজেশন ও এর উত্তর

Leave a Comment